শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪

কথাগুলো বলা হলো না,পর্ব -৩

আজ মাসের প্রথম রবিবার, বিধুকাকু আর অলোককাকু আজ আবার আমাদের বাড়িতে এলেন আর মা আজ আবার ওনাদের গান গেয়ে শোনালো

রাধা, তেরে শ্যাম কো হামনে গোকুল মে দেখা

---

রাধা ধোন্ধ রাহি, কিসিনে মেরা শ্যাম কো দেখা

রাধা ধোন্ধ রাহি, কিসিনে মেরা শ্যাম কো দেখা

মায়ের গান শেষ হলে অলোককাকুই কথাটা তুললেন, বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, বুঝলেন দাদা আমার চেনাজানা একজন গুরুজি আছেন, নাম পণ্ডিত অনুপ তলাপাত্র, মানুষটা একটু খ্যাপাটে টাইপের হলে কী হবে রাগসঙ্গীতে ওনার কিন্তু বিশাল দখল, অলোককাকু আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, বিধুকাকু ওনাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, পণ্ডিত অনুপ তলাপাত্র! তুমি ওনাকে চেনো নাকি?

চিনি মানে আমিও এক সময় পন্ডিতজির কাছে কিছুদিন তালিম নিয়েছিলাম, আর তাছাড়া আমাদের কোম্পানি থেকে ওনার বেশ কিছু ক্যাসেট বেরিয়েছে, সেই সূত্রেই চেনা-জানা আর কি, যাই হোক যা বলছিলাম, এরমধ্যে একদিন গুরুজির বাড়িতে গিয়েছিলাম আর সেদিন কথায় কথায় বৌদির গানের কথাটা তুলে ছিলাম ওনার কাছে।

সবাইকে চা পরিবেশন করে মা রান্নাঘরের দিকে ফিরে যাচ্ছিল, বিধুকাকু বলে উঠলেন, যেয়ো না বৌঠান, বসো, তোমার কথাই হচ্ছে। চায়ে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে অলোককাকু আবার বলতে শুরু করলেন, গুরুজিকে রাজী করিয়েছি, উনি বৌদিকে নিয়ে একদিন ওনার বাড়িতে আসতে বলেছেন, গান শুনবেন সেদিন, তারপর দেখুন কী হয়, বৌদির ভাগ্যে লেখা থাকলে হয়তো উনি শেখাতে রাজী হয়ে যাবেন আর উনি যদি সত্যিই বৌদিকে শেখাতে রাজী হন তাহলে কিন্তু সেটা বৌদির জীবনের একটা মস্ত বড় আশীর্বাদ হবে।

আরে এ তো দারুণ খবর! বিশ্বনাথ তুমি জানো কি না জানি না, এই পণ্ডিতজি কিন্তু রাগসঙ্গীতের জগতে সত্যিই একজন দিকপাল! বিধুকাকুর গলায় রীতিমত উচ্ছ্বাস।

অলোককাকুর কথামত পরের শনিবার ঠিক বিকেল পাঁচটায় আমরা ভবানিপুরের পূর্ণ সিনেমার কাছে এসে পৌঁছলাম, পন্ডিতজির বাড়িটা সিনেমাহলের ঠিক পিছনেই, কলিং-বেল বাজাতে একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক এসে দরজা খুলে দিলেন, আমাদেরকে হলঘরে বসতে বলে ভদ্রলোক ভি তরে চলে গেলেন। হলঘরের মেঝে জুড়ে ফরাস পাতা, ফরাসের ওপরই আমরা বসলাম, বাবা আর কাকু নিজেদের মধ্যে টুকটাক কথা বলে চলেছেন, মা ঘরের চারপাশটায় নজর করে দেখছে, ফরাসের যেদিকে আমরা বসে আছি তার দেওয়াল ঘেঁসে তবলা, হারমোনিয়াম বা তানপুরার মত অনেক বাদ্যযন্ত্র রাখা রয়েছে, বাদ্যযন্ত্রগুলোর পাশে ছোট্ট একটা টেবিল, তাতে হাত দুয়েকের মত লম্বা একটা সরস্বতী ঠাকুরের মূর্তি, ঘরের চার দেওয়ালে গুরুজির গান গাওয়ার আর সম্মানিত হওয়ার অনেক ছবি, একটা ছবিতে দেখলাম ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রী ওনার গলায় মালা পরাচ্ছেন। মাকে ওভাবে ঘরের চারপাশে তাকাতে দেখে অলোককাকু জানালেন যে এই ঘরেই নাকি পণ্ডিতজি ওনার ছাত্র-ছাত্রীদের গান শেখান।

আমাদের টুকটাক কথা বলার মাঝে পণ্ডিতজি এক সময় ঘরে এসে ঢুকলেন, সবাই আমরা উঠে দাঁড়িয়ে ওনাকে নমস্কার জানালে প্রতি নমস্কারে উনি আমাদের বসতে বললেন, নিজেও গিয়ে বসলেন ফরাসের এক কোনে। বেঁটেখাটো মানুষটার গায়ের রঙ তামাটে, মুখ ভর্তি সাদাকালো দাড়ি যা প্রায় বুক অবধি নেমে এসেছে, মুখে অত দাড়ি হলে কী হবে ভদ্রলোকের মাথায় কিন্তু বেশ বড়সড় একটা টাক আর সেই টাকটার ওপর এখন টিউব লাইটের আলো এসে পড়ায় সেটা ভীষণ চমকাচ্ছে, যতই ভাবছি ওদিকে তাকাব না ততই যেন আমার দৃষ্টি বারবার ওদিকেই চলে যাচ্ছে। দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে পণ্ডিতজি কাকুকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন, বল বেটা, কেমন আছিস?

নিজের কুশল জানিয়ে কাকু এবার আমাদের সবার সঙ্গে ওনার আলাপ করিয়ে দিলেন, মাকে দেখিয়ে বললেন, গুরুজি, ইনিই হচ্ছেন আমার সেই বৌদি যার কথা সেদিন আপনাকে বলেছিলাম।

হ্যাঁ রে বেটী, অলোক তো সেদিন তোর গানের খুব প্রশংসা করছিল, তা একখানা গান গেয়ে শোনা দেখিনি।

অলোককাকু দেওয়ালের পাশে রাখা হারমোনিয়ামটার দিকে হাত বাড়াতে যাচ্ছিলেন, মানা করলেন পন্ডিতজি, হারমোনিয়াম থাক, খালি গলাতেই বরঞ্চ বেটীর গান শুনি, আলাপের শুরুতেই এত বড় একটা মানুষ গান গেয়ে শোনাতে বলেছেন, মায়ের চোখেমুখে দেখি রাজ্যের টেনশন, পণ্ডিতজিরও নজর এড়ালো না সেটা, আরে বেটী তুই এত ঘাবড়াচ্ছিস কেন, মনে কর এই ঘরে কেউ নেই আর নিজেকেই তুই নিজে গান গেয়ে শোনাচ্ছিস, কী যেন ছিল ওনার গলায়, মা দেখলাম পন্ডিতজির পা ছুঁয়ে গেয়ে উঠলো

রবসোঁ নেহ লগা তু মন বা

দুজো নাহি শরন বা।

...

সাঁচো সুখী কোউ জগমে ন দীসত

হর রঙ্গ মান বচন বা।

গান শেষ, মায়ের মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে পণ্ডিতজি এক সময় বলে উঠলেন, বলতো বেটী, এ গান কোন রাগে গাওয়া ?

মাথা নেড়ে মা জানালো যে সে জানে না গানটা কোন রাগে গাওয়া, ছোটবেলায় এক সাধুবাবাকে গানটা গাইতে শুনেছিল আর সেই থেকেই সুরটা মনে গেঁথে রয়েছে।

বেটী এ হলো বিলাবল রাগে গাওয়া, অলোক ঠিকই বলেছে, তোর গানের গলা খুব মিষ্টি, দরদও আছে গলায়, কিন্তু একটা কথা মনে রাখবি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত কিন্তু শুধু দরদ দিয়ে গাইলেই চলবে না, তার সঙ্গে তোকে গানের ব্যাকরণগুলিও জানতে হবে, এই যে তুই গাইছিলি, অনেক জায়গাতেই কিন্তু সুর কেটে যাচ্ছিলি, যদিও তোর গাইবার আবেগে সাধারণ শ্রোতারা হয়তো সেগুলি ধরতে পারবে না কিন্তু সত্যিকারের সঙ্গীত প্রেমিককে কিন্তু তুই ফাঁকি দিতে পারবি না। একটু থামলেন উনি, নিজের চিবুকটা বুকের সঙ্গে ছুঁইয়ে কয়েক সেকেন্ড চোখ বন্ধ করে রইলেন আর তারপর ধীরে ধীরে মাথাটাকে ছাদের দিকে তোলার ফাঁকে বেশ বড় একটা শ্বাস নিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন, শোন বেটী, রাগসঙ্গীত শিখতে গেলে তোকে এখন থেকে নিয়মিত রেওয়াজ করতে হবে আর তার সঙ্গে গানের ব্যাকরণগুলিও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিখে নিতে হবে, কথাগুলি বলে আমাদের সবাইকে চমকে দিয়ে হঠাৎ উনি গেয়ে উঠলেন

স র গ ম প ধ ন র্স

এটা হলো তোর গাওয়া গানের আরোহণ, এবার অবরোহণটা শোন

র্স ন ধ প ম গ র স

আবার গানটাকে যখন তুই চলনে (পকড়ে) ধরবি তখন এর সুরটা হবে

র গ ম প ধ, ন ধ র্স, ন ধ প ধ ম, গ ম র স

ঘরের সবাই আমরা নির্বাক এখন, পণ্ডিতজির গলাই শুধু ঘরের চার দেওয়ালে ভেসে বেড়াচ্ছে, ঠাট হচ্ছে গিয়ে হিন্দুস্তানি সঙ্গীতের এক বিশেষ প্রকাশ যা ভারতীয় সঙ্গীতকে শ্রেণীবদ্ধ করে রেখেছে আর বিলাবল হচ্ছে ঠাটদের মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় এক ঠাট, গল্পে আছে, হজরত বেলাল নাকি একটা বিশেষ সুরেই শুধু আজান দিতেন আর পরবর্তী কালে ওনার সেই সুরের প্রতিফলনকে ভিত্তি করেই বিলাবল রাগের সৃষ্টি ও নামকরণ হয়, একজন বয়স্ক ভদ্রমহিলা আমাদের সবার সামনে সরবতের গ্লাস এনে রাখলেন, নিজের গ্লাসে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে পণ্ডিতজি আবার বলতে শুরু করলেন, ঠাটের সৃষ্টি হয় শুদ্ধ আর কিছু অশুদ্ধ (বিকৃত) স্বরের সংমিশ্রণে, তবে সব ঠাটই যে শুদ্ধ আর অশুদ্ধ স্বরের সংমিশ্রণে তৈরি হবে তা কিন্তু নয়, এই যেমন বিলাবল, বিলাবল হচ্ছে এমন এক ঠাট যার সব স্বরই কিন্তু শুদ্ধ তবে এর চলন আবার বক্রগতি সম্পন্ন, আরোহণে যেমন এর মধ্যম আর নিষাদ কিছুটা দুর্বল তেমনি অবরোহণেও দেখবি গান্ধারও কিছুটা অস্ফুট ভাবে মিশে রয়েছে।

বিলাবল থেকেই তো পরে আরও অনেক রাগের জন্ম হয়েছে, তাই না গুরুজি, পণ্ডিতজির কথার মাঝে অলোককাকু বলে উঠলেন।

ঠিক বলেছিস, বিলাবল থেকেই পরবর্তী কালে আরও অনেক রাগের জন্ম হয়েছে। অর্জুন, আল-হিয়া, আশা, ইমন, কুকুভ, গৌড় মল্লার, দেশকার, দুর্গা, পাহাড়ি, বিভাস, বেহাগ, মাড়, এসবই হলো আসলে বিলাবল থেকে জন্ম নেওয়া এক একটা রাগ, কল্যাণেও দেখবি এর অনেক মিল আছে, তাই তো অনেকে বিলাবলকে প্রাতঃকালের কল্যাণও বলে থাকেন। কথাগুলি বলার ফাঁকে গুরুজি একবার আমাদের সবার মুখের দিকে তাকালেন, তারপর মাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, রাগ সঙ্গীতের আরও একটা বৈশিষ্ঠ কী জানিস, প্রত্যেকটা রাগের কিন্তু গাইবার জন্য দিনের এক-একটা প্রহর নির্দিষ্ট করা থাকে, অনেক ক্ষেত্রে এক একটা বিশেষ ঋতুও .........

পারব না, অসম্ভব, এই বয়সে আমার দ্বারা এত কিছু শেখা সম্ভব নয়, পন্ডিতজীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমরা এখন বাসস্টপে এসে দাঁড়িয়েছি, বাবাকে চুপ করে থাকতে দেখে অলোককাকুই মায়ের কথার উত্তর দিলেন, আরে বাবা, আপনি এত ঘাবড়াচ্ছেন কেন, জীবনে প্রথমবার এসব কথা শুনলেন তাই ওরকম মনে হচ্ছে, কিছুদিন গুরুজির কাছে ক্লাস করুন, দেখবেন তখন আপনিও সঙ্গীত জগতের এসব কথায় কীরকম পারদর্শী হয়ে যাবেন, কাকুর কথার ফাঁকে আমাদের রুটের বাসটা এলো আর বাবা দু-দিকে মাথা নাড়তে নাড়তে বাসের দিকে এগিয়ে গেলে আমরাও বাবার পিছু নিলাম, বাসে ওঠবার আগে অলোককাকু বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, দাদা, এবার কিন্তু বৌদিকে একটা হারমোনিয়াম কিনে দিতে হবে আর সেটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ততই ভালো।

দু’ঘণ্টা লাগলো বাড়ি ফিরতে আর বাড়ি ফিরেই শুরু হয়ে গেলো আমাদের গোলটেবিল বৈঠক। ফেরার পথে বাজারের মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা বিধুকাকুকেও সঙ্গে করে ধরে নিয়ে এসেছিল বাবা। কাকু সব শুনে বললেন, আমি তো বুঝতে পারছি না তোমরা এটা নিয়ে কী এত ভাবছ। বৌঠানের জীবনে এটা এক মস্ত সুযোগ, সুতরাং বেশী ভাবা-ভাবি না করে তোমরা দেখো কত তাড়াতাড়ি বৌঠান ক্লাস শুরু করতে পারে।

না মানে, আমি কী বলছিলাম, বাবা তোতলাতে শুরু করলো, মানছি এটা কাজলের জীবনে একটা মস্ত সুযোগ, কিন্তু .... বাবা তার কথা শেষ করতে পারে না, তার আগেই মা বাবার কথা কেড়ে নিয়ে বলতে শুরু করে, দাদা প্লিজ বোঝার চেষ্টা করুন, আপনাদের মত নিজেদের লোকদের সখ করে দু'একটা গান গেয়ে শোনানো আর সত্যিকারের সঙ্গীত চর্চার মধ্যে কিন্তু অনেক পার্থক্য আছে।

সে তো আছেই কিন্তু তা বলে এত বড় একটা সুযোগ তুমি হাতছাড়া করবে সেটাও তো ঠিক নয়।

দাদা প্লিজ আমার কথাটা একটু বোঝার চেষ্টা করুন, আমি জানি এটা আমার জীবনে মস্ত একটা সুযোগ কিন্তু একটা কথা তো মানবেন যে ওনার কাছে গান শিখতে শুরু করলে এখন থেকে আমাকে নিয়মিত রেওয়াজ করতে হবে, তারপর ধরুন সপ্তাহে দু-দিন করে ঐ ভবানিপুর যেতে হবে, এমনিতেই সংসারের এত কাজ, তার ওপর বাবুও দিন-দিন বড় হচ্ছে, আমার পক্ষে কি এখন ঘর সংসারের সব কাজ ফেলে এসব করা সম্ভব?

ঠাকুমা এতক্ষণ চুপ করে সবার কথা শুনছিল, মায়ের বলা শেষ হলে ঠাকুমা এবার মুখ খুললো, বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললো, শোন বিশু, সবাই যখন বলছেন যে এই ভদ্রলোক এত বড় একজন গাইয়ে তখন আমার মনে হয় বৌমার গান শেখানোর ব্যাপারে আমাদের আর কোনও দ্বি-মত থাকা উচিৎ নয়, আর দেখ, কার ভাগ্যে কী লেখা আছে সেটা আমরা কেউই জানি না, হয়তো দেখবি পণ্ডিতজির কাছে গান শিখে সত্যিই আমাদের বৌমা একদিন খুব বড় গাইয়ে হয়ে উঠবে, আর বৌমা সংসারের কাজ নিয়ে তোমায় অত চিন্তা করতে হবে না, যতটা পারবে করবে, বাকীটা আমি ঠিক সামলে নেব, মায়ের মাথায় আশীর্বাদের ভঙ্গীতে নিজের ডান হাতটা রেখে ঠাকুমা বলতে থাকে, বৌমা এটা তোমার জীবনে মস্ত একটা সুযোগ, এটাকে তুমি হেলাফেলা করো না।

মা মেঝের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে, বুঝতে পারছি মায়ের মনের মধ্যে ইচ্ছে-অনিচ্ছার প্রচণ্ড একটা দ্বন্দ্ব চলছে, একদিকে সাংসারিক কাজের দায়বদ্ধতা, অন্যদিকে ছোটবেলা থেকে মনের গভীরে পুষে রাখা সুপ্ত স্বপ্নের সাকার হয়ে ওঠার সম্ভাবনা, ঠাকুমা অবশ্য মায়ের সেই টানাপড়েনকে বেশীক্ষণ স্থায়ী হতে দিল না, বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললো, শোন বিশু, বৌমার বুধবারের ক্লাসে যাওয়া নিয়ে তোকে অত চিন্তা করতে হবে না, সেরকম হলে আমি না হয় বুধবার করে ওর সঙ্গে যাব, তুই তাড়াতাড়ি করে বরঞ্চ বৌমাকে একটা হারমোনিয়াম কিনে দে।

পরের সপ্তাহের সোমবার অফিস ফেরত অলোককাকুকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে মায়ের জন্য বাবা একটা হারমোনিয়াম কিনে নিয়ে বাড়ি ফিরল।

গাইবার ধরন অনুসারে রাগ সঙ্গীতকে আমরা মোটামুটি চার ধারায় ভাগ করে নিতে পারি। ধ্রুপদ, খেয়াল, টপ্পা আর ঠুমরী, তবে এসবের ভীতরে ঢোকার আগে তোকে এটা জানতে হবে যে রাগ সঙ্গীত আসলে হচ্ছে গিয়ে কমপক্ষে পাঁচটি স্বর আর বর্ণ দ্বারা ভূষিত একটা ধ্বনি যা আমাদের মনে এক বিশেষ আবহ বা হিন্দোলের সৃষ্টি করে ...

সেদিন যে ঘরটায় আমরা বসেছিলাম আজ সেই ঘরে এখন মায়ের ক্লাস চলছে, আমি আর বাবা পাশের ছোট ঘরটায় বসা, সেদিনকার সেই ভদ্রলোক যিনি আমাদের দরজা খুলে দিয়েছিলেন এক সময় এক হাতে চায়ের কাপ আর অন্য হাতে একটা প্লেটের ওপর দুটো রসগোল্লা নিয়ে ঘরে ঢুকলেন, বাবার সামনে চায়ের কাপটা নামিয়ে আমায় বললেন রসগোল্লা দুটো খেয়ে নিতে আর তার সঙ্গে এটাও বললেন যে মাকে এখন থেকে যেন আমরা নিয়মিত দুধ, ছানা, এসব খেতে দেই, নাহলে মায়ের দুবলা শরীরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে এই আ... আ... আ করাটা মোটেই সম্ভব হবে না, কথাগুলি বলে ভদ্রলোক চলে গেলে আমি আবার পাশের ঘরের সঙ্গীতচর্চায় মন দিলাম, ..

. সুরের দার্শনিক বিচার করা যায়, সুরের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করা যায় কিন্তু তাতে সুরের মর্মবাণীর কাছে পৌঁছনো যায় না, পাওয়া যায় না তার গূঢ় তত্ত্বের সন্ধান, ঐ তত্ত্বের সন্ধান পেতে গেলে তোকে সুরের সাধনায় মেতে উঠতে হবে, আর সত্যিকারের সুরের সাধনায় যেদিন তুই মেতে উঠবি সেদিন দেখবি এই পার্থিব দুনিয়াটা তোর কাছে কেমন যেন অনাবশ্যক হয়ে গেছে, ছয় রাগ আর ছত্রিশ রাগিণীই তখন তোর ঘর সংসার হয়ে উঠবে, দীপক, মেঘ, ভৈরব, মালকোষ, শ্রী আর হিন্দোল, এদের মূর্ছনাতে দেখবি তোর শ্বাস-প্রশ্বাস কেমন যেন একাকার হয়ে যাচ্ছে

রে মন সুর মে গা

রে মন সুর মে গা

রে মন সুর মে গা

কোয়ি তার বেঁসুর না বোলে, না বোলে

রে মন সুর মে গা

দিল যো ধড়কে তাল বাজে রে

দিল যো ধড়কে তাল বাজে রে

তাল তাল মে সময় চলে রে

সময় কে সাঙ্গ হো যা

সময় কে সাঙ্গ হো যা

সময় কে সাঙ্গ হো যা

রে মন সুর মে গা

সুরের অস্তিত্বের সঙ্গে তোর মনের স্বত্বার যেদিন মিলন হবে সেদিন দেখবি তোর আত্মাও সুরের ভুবনে লীন হয়ে যাবে, আমাদের বুকের মাঝে কান পাতলে যেমন আমরা প্রতিনিয়ত হৃৎপিণ্ডের লয় তান মেনে বেজে চলা শুনি সেদিন দেখবি তোর মনের মধ্যেও একটা সুরের হৃৎপিণ্ড যেন অহর্নিশ গুণগুণ করে বেজে চলেছে।

ওহে ভ্রান্ত পণ্ডিত, এত বছর ধরে মন্দির বা মসজিদের যেসব পথ নির্দেশিকা তুমি এঁকেছ আজ তা আমি মুছে দিয়ে এলাম, মুছে দিয়ে এলাম জীবনের সঞ্চিত সব পাপ, পুড়িয়ে দিলাম পৃথিবীর বুক জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা সমস্ত মন্দির বা মসজিদ, বিশ্ব জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা সমস্ত চার্চের দেওয়াল ভেঙ্গে মুক্ত করে দিয়ে এলাম ক্রুশবিদ্ধ পিতাকে ... মিছিলের সব চেয়ে এগিয়ে থাকা মানুষটি বিড়বিড় করে নিজের মনে কথাগুলো বলে চলেছেন, সময়টা রাত বা দিন কোনটাই যেন ঠিক নয়, একটা সাদাকালো ধোঁয়াশে রঙ পৃথিবীটাকে এই মুহূর্তে মুড়ে রেখেছে যেন আর সেই মন খারাপ করা ধূসর আলোয় ছায়া-মানবের একটা সুশৃঙ্খল বাহিনী হেঁটে চলেছে দূরের পাহারটার দিকে, পাহাড়ের শিখর ছুঁয়ে নীলাভ যে শিখা জ্বলছে সেখানেই তাদের গন্তব্য, ওদের সবার পোশাক এক রকম, কালো আলখাল্লা, মাথার চুল আজানুলম্বিত, পুরুষদের মুখে অনেকদিনের না কাটা দাড়ি, মুখ নিচু করে সবাই ওরা পায়ে-পায়ে এগিয়ে চলেছে, প্রতিটি মানুষ আগের মানুষটির কাঁধে নিজের ডান হাতের মুষ্টি ছুঁইয়ে রেখেছে আর ওদের বাঁ হাতে সবার একটা করে দণ্ডি ধরা, সেই দণ্ডির পাদদেশ প্রতি পদক্ষেপে পায়ের তলার শক্ত মাটি ছুঁয়ে যাচ্ছে কিন্তু মাটির বুকে দণ্ডির স্পর্শ কোনও শব্দ তুলছে না, শব্দহীন এই পৃথিবীতে ছায়ার সরণীটা ছাড়া আর যেন কোথাও কিচ্ছু নেই, মাথার ওপর আকাশ তাও আজ অনন্ত এক শূন্য, মেঘ নেই, রোদ্দুর নেই, চাঁদ বা তারারাও অনুপস্থিত সেখানে, নিঃশব্দ এই পৃথিবীর নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে সারিবদ্ধ ছায়াগুলোই মাঝে মাঝে শুধু অজানা কাউকে উদ্দেশ্য করে বলে চলেছে, দয়া করো প্রভু, পাপে ভরা এই জীবন থেকে আমাদের মুক্তি দাও, ওদের সমবেত কণ্ঠস্বর দূরের পাহাড়ে ধাক্কা লেগে ফিরে ফিরে আসছে, সবার আগে চলতে থাকা ছায়াটি যিনি সম্ভবত এই দলটির দলপতি হবেন তিনিই শুধু মাঝে-মাঝে নিজের মত করে কিছু বলে চলেছেন, তিরতির করে কাঁপতে থাকা ওনার ঠোঁট দুটো যেন দূরের পাহারকে উদ্দেশ্য করে বলে চলেছে, দয়া করো প্রভু, শেষ পর্যন্ত আমরা যেন তোমার পাদদেশে গিয়ে পৌঁছতে পারি, আমাদের শরীর জুড়ে লেগে থাকা এই পাপ যেন আজ তোমার ঐ আলোক শিখায় পুড়িয়ে ফেলতে পারি ...

ছায়ার সরণীটা এক সময় পাহাড়ের পাদদেশে এসে দাঁড়ালো, এতক্ষণের অনুভূতিহীন মুখগুলিতে এখন কী ভীষণ খুশীর ছোঁয়া, পাহাড়ের মাথায় লেগে থাকা নীলাভ সেই শিখাটাও এখন সারা আকাশের বুকে ছড়িয়ে পড়েছে আর সেই শিখায় পৃথিবীর বুকে লেগে থাকা ধোঁয়ার চাদরটা সরে গিয়ে এখন সেখানে যেন এক স্নিগ্ধ আলো... আমি জানি এই আলো আসলে আমার মায়ের মুখে লেগে থাকা সব সময়ের সেই হাসিটা, মায়ের মুখের ঐ হাসিটাই এখন আকাশের বুকে আলো হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে, সারা আকাশের বুকে আমি যেন আমার মাকে দেখতে পাচ্ছি এখন, ঐ তো আমার মা, এক-এক করে ডেকে নিচ্ছে কালো আলখাল্লায় ঢাকা শরীরগুলোকে আর তারপর নিজের মুখে লেগে থাকা নীলাভ শিখায় ওদের শরীর আর মনের সমস্ত পাপ পুড়িয়ে দিচ্ছে আর সেই পাপ পোড়া ধোঁয়ায় আকাশের বুকে জন্ম নিচ্ছে কালো এক মেঘ, সেই মেঘের কান্নাই তারপর এক সময় বৃষ্টি হয়ে নেমে এলো পৃথিবীতে ... কালো আলখাল্লায় ঢাকা মানুষগুলো বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আকাশের দিকে তাকিয়ে এখন হাত জড়ো করে প্রণাম করছে...ওরা প্রণাম করছে আমার মাকে ... খোলা দরজা দিয়ে কখন যেন ভোরের আলো আমাদের ঘরের মেঝেতে আলপনা এঁকে রেখেছে, চোখ মেলে দেখি মা আলপনার বৃত্তে বসে প্রতিদিনকার মত রেওয়াজ করছে, গুটিসুটি বিছানা থেকে নেমে আসি, খুব ইচ্ছে করছে মায়ের কোলে মাথা রেখে কিছুক্ষণ চুপ করে শুয়ে থাকি, কিন্তু ঠাকুমা বাড়ন করেছে, মা যখন রেওয়াজ করবে তখন যেন মাকে একদম বিরক্ত না করি।

কী রে, আজ যে বড় সকাল-সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়লি!

মায়ের রেওয়াজ শেষ, আমি একলাফে বিছানা থেকে নেমে মায়ের কোলে মুখ গুঁজি, মা, ভোরের ঐ গানটা গাও না একবার।

হারমোনিয়ামের রিডে আঙুল রেখে মা গাইতে শুরু করে

ভোর ভঁয়ে পাঙঘাট পে

মোহে নটখট শ্যাম সাঁতায়ে

মোরি চুনারিয়া লিপাটি যায়ে

ম্যায় ক্যা করু হায় হায়

ম্যায় ক্যা করু হায় রাম হায়ে

ভোর ভঁয়ে পাঙঘাট পে

গানের কথাগুলি এখন পেঁজা তুলোর মত আকাশের বুকে ভেসে যাচ্ছে, ভোর ভঁয়ে পাঙঘাট পে, ঘরের মেঝেতে ছায়া পড়লে চেয়ে দেখি কখন যেন শহরে যাওয়ার প্রথম বাসটা এসে দাঁড়িয়েছে আমাদের বাড়ির সামনে, চোখ খোলো মা, দেখো, এক বাস লোক তোমার গান শুনে কেমন চুপ করে বসে রয়েছে, কেউ চীৎকার করছে না, কথা বলছে না, চুপ করে ওরা আমাদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে রয়েছে, দেখো মা, একবার দেখো, নিজের মনে বলা কথাগুলি মায়ের কানে গিয়ে পৌঁছয় না, মায়ের বন্ধ দু চোখের কোল বেয়ে এখন মুক্তোর দানার মত জলের ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে,

ভোর ভঁয়ে পাঙঘাট পে

মোহে নটখট শ্যাম সাতায়ে

মোরি চুনারিয়া লিপাটি যায়ে

ধুলোর ঝড় উড়িয়ে বাসটা এক সময় আবার চলতে শুরু করে, ও মা চোখ খোলো, চেয়ে দেখো বাসভর্তি লোক চলে যাচ্ছে, দেখবে না তুমি ওদের, দেখবে না একবাস লোক কেমন তোমার গান শুনতে শুনতে পাড়ি দিচ্ছে এখন শহরের দিকে, জানলার পাশে বসে থাকা বুড়োমানুষটা যিনি কিনা এতক্ষণ আমাদের বাড়ির দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে ছিলেন তিনি এখন হাতদুটো জড়ো করে আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রণাম করছেন, প্রণাম করছেন উনি অজানা কোনও শক্তিকে আর নিজের মনে বিড়বিড় করে কিছু বলে যাচ্ছেন, ওনার তিরতির করে কাঁপতে থাকা ঠোঁট দুটো থেকে নিঃসৃত কথাগুলো আমি যেন এতদূর থেকেও শুনতে পাচ্ছি, শুধু উনিই নয়, একবাস লোক এখন মায়ের সঙ্গে একই সুরে গাইতে গাইতে চলেছে, ভোর ভঁয়ে পাঙঘাট পে ...