বুধবার, এপ্রিল ১৭, ২০২৪

আকনবিন্ধীর সোনাপোকা,প্রথম অধ্যায় - ৪

লেখক পরিচিতি – ১৯৬২ সনে শিবসাগরের গড়গাঁওয়ে বন্তি শেনচোয়ার জন্ম হয়। শিলঙের উত্তর পূর্ব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী।বর্তমানে গুয়াহাটির রাধা গোবিন্দ কলেজের ইংরেজি বিভাগ থেকে সদ্য অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা। প্রকৃতিপ্রমিক এই লেখিকার প্রকাশিত গল্প গ্রন্থ যথাক্রমে ‘নিষাদ গান্ধার’,’সরলা আরু সুন্দর’,’দুপুরের পার চরাই’এবং ‘মৌ-সরা’। সম্প্রতি প্রকাশিত উপন্যাস ‘আকনবিন্ধীর সোণপরুয়া’। উপন্যাসটির পটভূমি শিলঙের উত্তর পূর্ব বিশ্ববিদ্যালয়। উপন্যাসটিতে নেহুর প্টভুমিকায় সমগ্র উত্তরপূর্বের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চিত্র ফুটে উঠেছে ।

5f01cac28dd11.jpg

- বনশ্রী,নাইস মেখলা।

-মেখলা নয়,মেখেলা। সকাল থেকে মাত্র একজনকে পেলাম যে শাড়ির সঙ্গে পার্থক্যটা বুঝতে পারে।তবু গণ্ডগোল থেকে গেল। বল,মেখেলা-চাদর।

নাওমি বুয়ান দার্শনিকের মতো দুপাশে মাথা নাড়ে। বরফের মতো ঠাণ্ডা হাতটা তখনও বনশ্রীর মণিবন্ধ খামচে ধরে রয়েছে।

-আমার মা মেখেলা-চাদর পরতেন। তুমি জান না! আমার নাম পরবর্তীকালে বিবলিক্যাল করা হল। নাওমি। তোমরা যেভাবে ডাক নমি,নমি আমার আসল নাম।

নাওমির মুখে অসমিয়া শুনে বনশ্রী বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেল। ইংরেজি ছাড়া অন্য কোনো ভাষার শব্দ তো দূরের কথা, একটা ইস-আস সূচক শব্দও তার মুখে শুনেছে বলে মনে পড়েনা।বনশ্রীর নিজেকে অপরিচিত বলে মনে হতে লাগল।ক্লাসরুমে সে নিজেকে একমাত্র অসমিয়া বলে জানে। একটা সেমিস্টার শেষ হতে চলেছে।অসমিয়ায় কথা বলতে হলে সে ঝুমুরের বাংলা-অসমিয়ার স্বাদ নেয়। অথচ নাওমি অর্থাৎ নমি এত সুন্দর অসমিয়া –মানে অসমিয়াই-

-তুমি অসমিয়া বলতে পার ? মানে জান ?

-আমি অসমিয়াই। বুয়ান,ফেমাস টাইটেল।বুইয়ান ইউ কল ইট।

-নমি ভূঞা !

-দ্যাটস রাইট।মায়ের ফোটোগুলিতে দেখি,মা কেবল মেখেলা চাদরই পরতেন। ইউ নো। ওনলি ড্রেস।কিন্তু তুমি যে ক্লাসে পরে আস-কান্ট হেল্প বাট এপ্রিসিয়েট!

-কিন্তু নাওমি,মানে নমি !

-বনশ্রীর বিস্ময়ের রেশ শেষ না হতেই নাওমি নিজের বক্তব্য দ্রুত অসমিয়ায় বলতে অসুবিধা হওয়ায় পুনরায় ইংরেজির শরণাপন্ন হয়।

বনশ্রীর ভেতরে ভেতরে অভিমান হয়। ক্লাসরুমের কথা আলাদা,অন্য বন্ধু বান্ধবের উপস্থিতি,আলাদা পরিবেশ। নাওমি একাধিকবার বনশ্রীর সঙ্গে হোস্টেলে দেখা করেছে। অজস্রবার হোস্টেলে,ক্লাসে দুজন দুজনকে কাছে পেয়েছে। বনশ্রী অবশ্য নমিকে জিজ্ঞেস করেনি সে কোথা থেকে এসেছে। জানে পড়াশোনা দার্জিলিঙে করেছে।ব্যস।

-ইস ! ফরগেট এবাউট দ্যাট। দ্যাটস নট ইমপরট্যান্ট !

নাওমির মুখ সত্যিই বনশ্রীর অবাক বিস্ময়ে প্রফুল্ল না হয়ে বিরস হয়ে পড়ল। সে বনশ্রীকে অফিসের করিডরের দিকে অঙ্গুলির নির্দেশে দেখাল।

-তোমাকে একজন যুবকের সঙ্গে দেখলাম।আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে তিনিই প্রশান্ত বরুয়া।

-তুমি ঠিকই ধরেছ।চেন ওকে?

-মোটামুটি। আমি চিনি,আমার সন্দেহ আছে তিনি আমাকে চিনতে পারবেন কিনা।

-চল,পরিচয় করিয়ে দিই। খুব ভালো লাগবে।

-পরিচয় করিয়ে দেবে ? কোনো দরকার নেই।প্রশান্ত,এই হল নমি ভূঞা। অসমিয়া মেয়ে ,জান কি-এটাই বলবে তো ? এসব আমার ভালো লাগে না।এমনিতেই জেনে রাখলাম,এই হল প্রশান্ত,তাই তো? ব্যস।এনিওয়ে, রিয়েল হ্যণ্ডসাম গাই । বাট অ্যাজ ইউজুয়াল,নট ফর নাওমি।

-নাওমি বুয়ানের জন্য কী নয়। হোয়াটস নট ফর নাওমি বুয়ান,ডিয়ার ? হঠাৎ কোথা এসে উপস্থিত হল তেজি।

-একজন স্বপ্নের কুমার। বনশ্রী উত্তর দেয়

-মাই মাই।

আজানুলম্বিত বেণীটা জীনসের পোশাকের ওপর নাচাতে নাচাতে তেজিমালা গুরুং ওদের মাঝখানে এসে দাঁড়াল।এই মেয়েটি কোনো কারণ ছাড়াই আনন্দ স্ফুর্তি করতে পারে। এখানকার পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের গর্ব নাকি মেয়েটি।জীবনে কখনও দ্বিতীয় হয়নি।দুরন্ত গতিতে গবেষণার কাজ শেষ করে এনেছে। অথচ এভাবে থাকে যে মনে হয় এই প্রথম সেমিস্টারে এসে নাম লিখিয়েছে,কিছুই যেন জানে না, হৈচৈ করে কাটানো মেয়ে।

তেজিমালা গুরুং । ঝালুপাড়ার মেয়ে। লেডি কীন কলেজের অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী।ঝালুপাড়ার বাড়ি থেকেই পিজি সম্পূর্ণ করেছে। কিসের বিড়ম্বনায় গবেষণার কাজে যোগ দিয়ে বিজনী হোস্টেলে থাকতে শুরু করেছে সেটা কেবল তেজিমালাই জানে। ঝালুপাড়ার নেপালি সম্প্রদায়ের জন্য তেজিমালার মেধা এক বিস্ময়কর জিনিস।দরং কলেজে চাকরি পেয়েও তেজিমালা যেতে চায় না।শিলঙে জন্ম।শিলং বাদ দিয়ে অন্য কোথাও থাকার কথা নাকি সে স্বপ্নেও ভাবতে পারে না। চাকরি ছেড়ে দিয়ে চার বছরের স্কলারশিপ নিয়ে গবেষণা আরম্ভ করেছে,কী যে মুশকিল, তিন বছরেই নাকি গবেষণা শেষ হয়ে যাবে।তারপর চাকরির হাত ধরে কোথায় গিয়ে পৌছাবে কে জান। বর্তমানে ঝালুপাড়া ছেড়ে তেজিমালা বিজনী হোস্টেলের বাসিন্দা হয়েছে ।ঝালুপাড়ার রত্ন এখন সুপার মিসেস ঝুনঝাপ্পার ক্ষুদ্র ভারতের রত্ন।

হ্যাঁ,’ক্ষুদ্র ভারতবর্ষ’। অন্তত মিসেস ঝুনঝাপ্পা নিজের হোস্টেলের বিষয়ে হোস্টেল আবাসিনীদের এভাবে আখ্যা দিয়েই সন্তোষ লাভ করেন।

-এই তো বিকেন।সেই সকাল থেকে তোকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। ভারতের প্রথম সারির সমালোচকের হৃদয়ে রাজ করতে পারা আমাদের বিকেন।ওম।

তেজিমালা বিকেনের গালে চট করে চুমু খেল। বিকেন মানুষটা হঠাৎ লাল হয়ে উঠল। বিকেনকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে জোসেফ তেজিমালার সামনে বসে হাঁটু মোড়ে বসার ভঙ্গিমা করল।সামনের দিকে গড়িয়ে আসা দীর্ঘ বেণীটা পিঠের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে তেজিমালা তার জীনস খামছে থাকা পা টা জোসেফের দিকে এগিয়ে দিয়ে তার প্রার্থনা শুনতে প্রস্তুত হল।

-তেজি, আগামীকাল থেকে আমিও কবিতা লিখতে শুরু করে দেব।বিকেনকে দেওয়া পুরস্কারটা আমাকে দিবি তো।

-বৎস ! কাল কেন? আজকেই আরম্ভ কর। কিন্তু অগ্রিম কোনো পুরস্কারের বিধান তেজিমালার অভিধানে নেই।

-সিরিয়াসলি।বিকেন অনন্য প্রতিভাধর। মূলস্রোতের সমালোচকদের চোখে পড়েছে। কম কথা নয় কিন্তু।

-কিন্তু মূল স্রোত জিনিসটা কী ? কেউ আমাকে বুঝিয়ে দিন তো। মূলস্রোতটা বিকেন শর্মার জন্ম হওয়া জায়গা থেকে অর্থাৎ লোগটাক হৃদ থেকে বয়ে যেতে পারবে না কেন? তাহলে তো বিকেনই মূলস্রোত হতে পারবে।কোনো মূলস্রোত বিকেনকে ধন্য করতে হবে না। বিকেনই মূলস্রোত।

-বাঃ আজ তোকে গেগং আপং বলে মনে হচ্ছে।

-কীভাবে?

-একবার মুখ্যমন্ত্রীদের বৈঠকে নাকি মূলস্রোত অনুকরণের নামে উত্তর ভারতের কয়েকজন টাগ-অফ-ওয়ার চালিয়ে চিৎকার করছিল।সময় অপচয় আর কাকে বলে ? ওদের উচ্চাত্মিকার রকম সকম দেখে একটা সময়ে গেগং আপঙ হুঙ্কার দিলেন।ছোট খাট মানুষটা বুক চাপড়ে সবাইকে প্রত্যাহ্বান জানালেন-মেইন স্ট্রিম ! মূলস্রোতকে অনুসরণ করতে হবে তো ? তাহলে আসুন,আমিই সেই মূল স্রোত,কাম এণ্ড ফলো মী,জেন্টলম্যান।

-দেখলি জোসেফ ?ছোট খাট মানুষের সাহস বেশি।

-উপায়ও তো নেই। লম্বা নাহলে কী করবি। আঙুর ফল টক বলেই সান্ত্বনা লাভ করতে হবে। উড়িষ্যার পাণিগ্রাহীর উদাসীন মন্তব্য শোনা গেল।

-রিয়েলি।ফুড ফর দি ডে।–নাওমি সেই একইভাবে বিজ্ঞের মতো ডাইনে-বাঁয়ে মাথা নাড়িয়ে বলল।

-নির্ঘাত নাওমি।কিছু সমাজ কর্মীর কাছে এই টুকরো খবরগুলি মিটিঙে গালিগালাজ করার ভালো উপাদান হতে পারে।

-তুমি বরং সাবধানে বক্তব্য উপস্থাপন কর। সমাজসেবা করি।সেখানে ভাষণের গুরুত্ব আসে কোথা থেকে? এই ধরনের খোঁচা দেওয়া আমি পছন্দ করি না।

-নাওমি বুয়ানকে গম্ভীর দেখাল।তাকে শান্ত করার জন্য প্রবোধ মিপুন এগিয়ে এল।

-নাওমি,দেখতে গেলে ভাষণের গুরুত্ব অনেক।মানুষের স্বভাবই এমন।আমাদের কথায় বলে যেচে দেওয়া সোনারও উচিত মূল্য নেই।কথা বা ভাষণ ছাড়া তুই চুপচাপ কাজ করতে গেলে বিপদে পড়বি কিন্তু দেখিস।মানুষ ভাববে না ফোটো না ভাষণ।কেন দিলে? কী মতলব কে জানে? কোনো পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানো আর তা করার জন্য প্রাণে মারার কোনো মতলব নেইতো।

নমি ভূঞাকে স্বাভাবিক করার জন্য প্রবোধ মিপুন দীর্ঘ ভাষণ আরম্ভ করে দিল ।কথকী ঝুমুরকে বনশ্রী সেখান থেকে টেনে নিয়ে আসতে হল।ওয়াই ডব্লিউ সি এর মেয়েদের শ্রোতা পেয়ে মিপুনের স্বর উচ্চগ্রামে চলতে থাকল।

-ওদেরই ভালো।কোনো চিন্তা নেই।সব সময়েই সানডে স্পিরিট।

-আমাদের সানডে বরবাদ।চল চল।শেষের দুটো ক্লাস পেতে হবে।

-হাই ক্যাব। নঠ’মাই যায়েগা ?

ড্রাইভার সম্মতিসূচক ভঙ্গি করে।মুখে তামোল পান।দুই ঠোঁটের পাশ দিয়ে পিক গড়িয়ে পড়ছে।সারা শরীরে জড়ানো রয়েছে কর্ডস উলের কাপড়। কাপড়টার দুটো মাথা পেছন দিকে নিয়ে গলার কাছে বাঁধা আছে।সে ঝুমুরদের দরজাটা খুলে দিল।ভিজে একটা গন্ধ ট্যাক্সি থেকে বেরিয়ে এসে দুজনেরই গালে মুখে লাগল।


চলবে ...