বৃহস্পতিবার, মার্চ ২৮, ২০২৪

আকনবিন্ধীর সোনাপোকা,-- ঠ

(ঠ)

গ্রেসেরজন্য আবাসিকারা বিদায় সভাটামিটিং রুমে করার জন্য সাজিয়ে গুছিয়ে তোলার কাজ আরম্ভ করেছে। মাথা গুণতির সময় ইতিপূর্বে ঝুনঝাপ্পা যেহেতু ঘোষণা করেছেন যে বিদায় ভোজের আয়োজন একটা হোস্টেলে করতে পারলে তিনি খুশি হবেন, তাই ডাইনিং হলটা সাজিয়ে গুছিয়ে তোলা হয়েছে। সারাবছর বড়দিন ছাড়া হোস্টেলে এই ধরনের সাজানো-গোছানো আর চোখে পড়েনি। আবাসিকারা মিটিং এর কার্যসূচি ঠিক করার সময় মায়া বরঠাকুর তাদের বিনামূল্যে উপদেশ প্রদান করে গিয়েছেন যে বিদায় সভার কাজ যেন কেবল শুধু চোখের জল বিসর্জন করার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রাখা হয়। তারচেয়েও গ্রেস বহুদিন পর্যন্তমনে রাখার মতো কিছুকরা যেতে পারে। ভিন্ন ভিন্ন দেশের মেয়েরা পরিবেশনকরা নৃত্য, কবিতা আবৃত্তি,হাসি-তামাসা।ভাষণ অবশ্যই থাকবে। বিদায়ী গ্রেসের অগ্রাধিকার থাকবে।ডঃঝুনঝাপ্পা বলবেন এবং আবাসিকাদের হয়ে বলবে কলাপী আচার্য।

কলাপী আচার্য কেন?

কারণ গ্রেসের জায়গায় এখন নতুন প্রীফেক্টর নির্বাচিত হয়েছে কলাপী আচার্য। নিজেদের প্রদেশের রাজধানী শহরটির সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত কলেজটি থেকে সুখ্যাতির সঙ্গে স্নাতক হওয়া ছাত্রী কল্যাণী। স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাড়ির ভাত খেয়ে পড়ার সুযোগ ছেড়ে শিলং শহরে গিয়ে থাকবে? কলাপী বাবার প্রস্তাবে প্রথমদিকে অবাক হয়েছিল।সে গণিত বিষয়ে সম্মানসহ স্নাতক।

বাস্তব অঙ্কটা তাকে বাবার বুঝিয়ে দিতে হল। অসম আন্দোলনশৈক্ষিক বছর গুলিতে বিশৃংখলার সৃষ্টি করতে শুরু করেছে। দুটো ছেলেই ইতিমধ্যে আন্দোলনে আক্ষরিক অর্থে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। একজন পড়াছেড়ে দিয়েছে। অন্যজন বাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। কলাপী পড়াশোনায় তীক্ষ্ণবুদ্ধি সম্পন্না। সে যদি সময়মতো বেরিয়ে আসে, অবসরের আগে আগে পিতার একটা সাহায্য হয়। বাকিদের কথা অনিশ্চিত।কলাপী পিতার কথায় সায় দিলএবং তাকে শিলঙে রেখেবাবা স্বস্তি পেলেন। এর চেয়েও বড় একটা স্বস্তি তার জন্য অপেক্ষা করে আছে বলে তিনি ভাবতেই চাইছিলেন না। বরং তিনি বারবার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। মেয়ে তার ডাকাবুকো। ভালো ক্যারিয়ারের সম্ভাবনা আছে।তিনি নিজে তাকে পড়াশোনার জন্য রেখে এসেছেন। সেক্ষেত্রে এখনই বিয়ে? কিছুদিন, একটা বছর অপেক্ষা করুক, যদি এতই তারা পছন্দ করে থাকে।

ছেলের পক্ষ অসন্তুষ্ট হয়েছে। কন্যা পক্ষের অসুবিধা এবং আপত্তি শুনে খুব অবাক হয়েছে। যেচে দেওয়া সোনা নিতে অস্বীকার করেছে!! কম কথা নয়! অবাক হওয়ার কথা নয় কি? শ্রীমতী আচার্য ভীষণ আশঙ্কিত হলেন। এই কথাই শেষ কথা নয়। এত আত্মবিশ্বাস মানুষটার। মেয়েটিকে নিশ্চয়ই সাংঘাতিক পছন্দ হয়েছে। আপত্তি করা সত্ত্বেও লেগে আছে। তাড়াতাড়ি বিয়েটা পাতার জন্য তারা আগে থেকে জোর করার কোনো কারণ নেই তা কিন্তু নয়। মলয়ের মায়ের মৃত্যু হয়েছে আজ একবছর। বাড়িতে দেখাশোনার কোনো মহিলা নেই,দূর সম্পর্কের একজন পিসি এসে দেখাশুনা করছে যদিও বারবার অন্য ব্যবস্থা করার জন্য বলছে। মলয় বড় ছেলে। উপযুক্ত বয়স। আড়ালে আবডালে শিলং গিয়ে মেয়ে দেখে এসেছে। সব ঠিক আছে। পড়াশোনা? দুটো সেমিস্টার মাত্র। বিয়ের পরও করতে পারবে। শ্রীমতী আচার্য আর আপত্তি না করার জন্য স্বামীকে বুঝিয়েছেন। এরকম উপযাচক হয়েআসা-- তারমধ্যে প্রতিষ্ঠিত ঘর, শিক্ষিত ছেলে, পরে যদি না পাওয়া যায়,তখন? কলাপীরও মত নিতে হবে।

কলাপী আপত্তি করল না। মা-বাবা তার ভালোর জন্য চেষ্টা করবে তাছাড়া পড়াশোনা করে থাকায় যখন তাদের আপত্তি নেই নিশ্চয় খারাপ হবেনা।দুটো কথায় সম্বন্ধের ব্যাপারে সে রাজি। বাবাকে জন্ম কুণ্ডলী পাঠিয়ে ছেলের হাত ভিক্ষে করতে হল না। দ্বিতীয় এবং আরও বেশি রোমাঞ্চকর কথাটা হল মলয় তাকে শিলং এসে দেখে গেল আর সে জানতেও পারল না।

বিয়ের পরের সেমিস্টার ব্রেকটা শেষ করে সে হোস্টেল আসার চিন্তা করতেই শ্বশুর তাকে ডেকে পাঠালেন।

অবসর নেবার পাঁচ বছর হয়েছে যদিও মানুষটার চেহারা দেখে বোঝা যায় না। কলাপীকে হোস্টেলে থেকে যাওয়ার চেয়ে মাঝেমধ্যে গিয়ে ক্লাস একটা দুটো করে পরীক্ষা দিয়ে ঝামেলাটা শেষ করার জন্য শ্বশুর মশাই পরামর্শ দিলেন। গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক বিভাগের থেকে অবসর নিয়েছেন। সেখানে এখনও সেমিস্টার পদ্ধতির প্রচলন হয় নি। তাই উপস্থিতি সম্পর্কে নিয়মকানুন নাও জানতে পারেন। 65% উপস্থিতি থাকতেই হবে। তাছাড়া ভালো রেজাল্ট করার জন্য ক্লাসগুলি নিয়মিত করতে হবে। কলাপী বুঝিয়ে বলল

‘কী করবে ভালো রেজাল্ট করে?’ চাকরি করে টাকা-পয়সা জমাবে? শোনো বৌমা, আমি একটা চাকরি থেকে যা রোজগার করেছি তিন পুরুষ বসে বসে খেতে পারবে। পাস করতে চাইছ, কোনোভাবে পরীক্ষাটা দিয়ে ঝামেলা শেষ করে সংসার কর। কলাপী নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। একটা বিভাগে চাকরি করে তিন পুরুষের জন্য সম্পদ সঞ্চয় করার গর্ব মানুষটার সাদা শার্টে ঝলমল করছে। তাকে নড়াচড়া করতে না দেখে মানুষটা উৎসাহী হয়ে উঠলেন।

-- ইউনিভার্সিটির কথা তুমি আমাকে কি শেখাবে? আমি অসমের সবচেয়ে সম্মানিত ইউনিভার্সিটিতে কাজ করেছি। তোমার শাশুড়ি যখন হায়ার সেকেন্ডারি পড়ে তখনই বিয়ে করেছি। ততটুকুই তার পড়াশোনা। তোমার শাশুড়ির উপার্জন কত তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।একদিনও বাড়ি থেকে না বেরিয়ে করা উপার্জন।আমিকোথাকার এমএ,পিএইচডি? সেই ধরনের ডিগ্রী থাকা কত প্রিন্সিপাল আমার টেবিলে একটা অনুদানের জন্য লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তোমার শাশুড়ির কাছে ইন্সুরেন্স না করা পর্যন্ত আমি কারো পিএইচডি রেজিস্ট্রেশন হতে দিইনি।

কলাপীর হোস্টেলে ফেরার প্রস্তুতিতে মলয় সাহায্য করে।কলাপী কী ভেবে মলয়কে হঠাৎজিজ্ঞেস করে

--’তোমার বাবাকে লোকে পিএইচডি শর্মা বলে কেন?’

-- ‘তোমাকে কে বলেছে?’ একদম বাজে কথা।

-- শুনেছি কোথাও।বলেছে?

-- মানুষের আর কী কাজ? কারও উন্নতি সহ্য করতে পারে না। বাবা আমাদের জন্য অনেক করেছেন। মায়ের নামে জীবনবীমার কাজটি করেছেন। পরিশ্রম আছে। আমাদের বুঝতে হবে যে বাবা সমস্ত কিছুই আমাদের জন্য করেছেন। অনেক কষ্ট করেছেন, অনেক কষ্ট করেছেন।

‘কষ্ট মানে কী?

-কেন অদরকারিসমস্ত কথা নিয়ে পড়ে আছ? এসব বাদ দাও। তুমি পড়তে চাইছ, পড়বে। হোস্টেলে কবে যাবে ভেবেছ?