শনিবার, এপ্রিল ২০, ২০২৪

আকনবিন্ধীর সোনাপোকা,-- ঞ

(ঞ)

সাদা-কালো ফোটোর অ্যালবাম।বহুদিন ধরে বন্ধ হয়ে পড়ে থাকার জন্য পৃষ্ঠা খুললেই অস্বাভাবিক কর্কশ শব্দ হয়।এই ধরনের পৃষ্ঠাগুলো থেকে জোড়া-তালি দিয়ে নির্মাণ করতে হবে নাওমি বুয়ানের কাহিনি।অ্যালবামের ফোটো গুলো থেকে উঠে এসে কোনো স্মৃতি তাকে আলোড়িত করতে পারে না।কারণ সেইসব অ্যালবামে সে একটি দেড় বছরের মেয়ে।অ্যালবামের সাদা-কালো ফটোগ্রাফির জগত থেকে আজকের রঙিণ ফোটোর পৃথিবীতে হেঁটে আসার অধিকার কেবল সেই দেড় বছরের মেয়েটিই পেয়েছিল।

বহুদিন পরে এখান-সেখান থেকে ছিটকে আসা টুকরো খবর,কারও স্বগতোক্তি,কোনো দুজনের কথোপকথন থেকে কোনোমতে জোড়া লাগানো তার কাহিনি।অনেক সময় নিরপেক্ষ দূরত্ব থেকে সে নিজের নির্মাণ যখন প্রত্যক্ষ করে,সে নিজেই বিশ্বাস করতে চায় না।অসন্তুষ্ট হয়ে ভেঙে ফেলে এবং পুনরায় অন্য ধরণে আরম্ভ করে।

এবং অন্য একটি সময়ে ভাঙ্গা-গড়ার এই নিরর্থক কাজটা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখতেও সে শিখেছে।

অ্যালবামের সূত্র ধরে ভাঙ্গা-গড়ার অন্তহীন কাজটি ছাড়াও পৃথিবীতে করার মতো আরও অনেক কাজ আছে।ক্রমাগত অ্যালবামের পৃথিবী থেকে সরে এসে সে ব্যস্ত জীবন-পরিক্রমায় পা রেখেছে।জীবনকে অন্য ধরণে দেখার মানসিকতা লাভ করেছে।

ফোটোগুলো থেকে বোঝা যায়,মা-বাবা এবং একটি কন্যা সন্তানের সঙ্গে সুন্দর একটি পরিবার।বিশাল বাংলো,সারি সারি চা গাছের পৃষ্ঠভূমি,পরিচারক-পরিচারিকা।

সুপুরুষ পিতার কোলে কখনও বাংলোতে আবার কখনও বাগিচার কোনো কোনো অংশে দেড়বছরের মেয়েটি।তুলনায় কিছুটা স্তিমিত মায়ের কোলে বসা রুমের সোফায় মেয়েটি।মায়ের পরনে মেখেলা-চাদর।অলিন্দে মা-বাবা দুজনেই তুলে ধরা অবস্থায় সেই মেয়েটি।দুই একটি ফোটোতে বুকে মেথনি বাঁধা মেখেলা সহ কিছু বয়স্ক মহিলা একজনের কোলে মেয়েটি।সাধারণ কিন্তু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন একটা ঘরের দরজার সামনে সেই মেথনি বাঁধা মেখেলা পরা মহিলার কোলে সমান অন্তরঙ্গ সেই মধ্যমণি মেয়েটি।

এই তিনজন ব্যক্তির কোল থেকে উঠে আসতে হবে নাওমি বুয়ানের কাহিনি অথবা কল্পকাহিনি।বিশাল বাংলোর আভাস সাদা-কালো ফোটোগুলো বহন করছে।সারি সারি শিরিষ গাছ চা গাছগুলিকে ঘিরে রেখেছে।বিশাল বারান্দাগুলো সুন্দর আইভিলতা বেস্টনীতে ঘিরে রেখেছে।কিন্তু কোনো বংশলতা নাওমি বুয়ানকে আষ্টে-পৃষ্ঠে কোথাও ঘিরে রেখেছে কি?জানা যায় না।অন্তত নাওমি বুয়ান জানে না।

এই সমস্ত ফোটো ছাড়াও আরও একদিনের পুঙ্খানুপুঙ্খ ফোটো নাওমি নাদেখেই আছে।সরকারি ফাইলে,আদালতে,আরক্ষীর হাতে থাকা সেটা একদিনের ফোটো।রাতের বেলা স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই শোবার ঘরের বিছানায় নৃশংসভাবে হত্যা করে গেছে।পরের দিন ভোর হওয়ার অনেক পরে,প্রায় দুপুরবেলা ঘরের অস্বাভাবিক নির্জনতা না কি চিৎকার করে করে ভেঙ্গে পড়া কণ্ঠের উৎসের খোঁজে বাগিচার কর্মচারী,শ্রমিক সেই অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখেছিল।দুপাশে রক্তে মাখামাখি হয়ে মা-বাবার মৃতদেহ এবং প্রাণ থাকলেও প্রাণহীন দুচোখে শান্ত হয়ে বসে থাকা মেয়েটি।

তাই বারবার ডানহাতের মণিবন্ধটা ঘুরিয়ে থাকা ছাড়া তখন আর কিছুই বলছিল না।তাকে কেউ সেখান থেকে তুলে নিয়ে সরিয়ে দিয়েছিল।

আরক্ষীর সঙ্গে ক্যামেরা এল,তন্ন তন্ন করে ফোটো নেওয়া হল। ঘরের মধ্যমণি সেইসব ফোটোর বাইরে রইল।

ভীষণ প্রতিপত্তিশালী বংশলতিকা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করেছিলেন ভদ্রলোক।দুর্ঘোর প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ উপেক্ষা করে অসবর্ণ বিবাহ করেছিলেন।নিজের আত্মীয় স্বজনদের বাধা নিষেধ অগ্রাহ্য করে সংসার কেবল আরম্ভ করেছিলেন।জনজাতীয় মূলের মহিলা।অনুমান করা যায় মেথনি বাধা মানুষটা পরিচারিকা নাহলেও পরিবারের নিশ্চয় আত্মীয়া। প্রচুর ধন সম্পত্তি।কিন্তু প্রায় সমাজ বিচ্ছিন্ন বস্তি।হয়তো বা ব্যক্তিগত ভাবে কিছু না হলেও দুজনেই উগ্রপন্থীর শিকার হয়েছিলেন।অনেকের মতে মেয়েটিকেও ভূঞা দম্পতি দত্তক নিয়েছিলেন। কাছে থাকতে দিয়েছিল সেই যোগসূত্রের পরিচারিকার পরিবারকে।

এই জটিল এবং বহুধাবিভক্ত তথ্যগুলো থেকে আজকের নাওমি বুয়ানের নির্মাণ সহজ কি?কালো-সাদা অ্যালবামটা সে অনেক আগেই ফেলে এসেছে।তার সঙ্গে একাত্ম হতে পারার মতো,তা থেকে সৌধ নির্মাণ করার জন্য স্মৃতি কোনোমতেই তাকে আলোড়িত অথবা প্রতারিত করেনি।কালো-সাদা ফোটো গুলোর জায়গায় দার্জিলিঙের মিশন স্কুল নিয়েছে।তার উষ্ণ পরিবেশ ধীরে ধীরে তাকে আজকের নাওমি বুয়ান করেছে।তাকে মুখের ভাষা দিয়েছে মিশন স্কুলের দরদী সিস্টার।তাকে জগত এবং জীবনকে দেখার সুযোগ দিয়েছে দার্জিলিঙ।বোর্ডিং স্কুল তার ঘর।বিশাল স্কুলের প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীই তার ঘরের।

কে বলে,তোমার কেউ নেই?এটাও সৃষ্টিকর্তার করুণা যে তোমাকে কেবল শিকড়ের এক জায়গায় বন্দি করে রাখে নি।সমগ্র জগত তোমার নিজের।তোমার দুর্বলতাকে তোমার সবল বিন্দু করে আরম্ভ কর।আত্মোৎসর্গের মনোভাব এবং উদারতা তোমার অস্ত্র হোক।তোমার কাজ এবং তোমার দরদী হৃদয় তোমার পরিচয়।

যে দূরে চলে গেল,যে ভুলে গেল,যার কাছ থেকে জীবনকে উদযাপন করার উপাদান পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই আর বাকি রইল না--ধীরে ধীরে নিজেকে সেখান থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেল।তোমাকে আদর করার জন্য সামনে অপেক্ষা করে থাকা হাতছানিকে শ্রদ্ধা করতে শেখ,সঙ্গ দাও।

নাওমি বুয়ানের এখনকার পরিচয় YWCA।

১৮৫৫ সনে গ্রেট ব্রিটেনে লেডি কিন্নরেইড আর মিসেস এম্মা রবার্টস আরম্ভ করা এই World’s Young Women’s Christian Association, সংক্ষেপে YWCA।

ব্রিটিশ নাগরিক লেডি কিন্নরেইড আর মিস এমা রবার্টস কি কল্পনা করতেও পেরেছিলেন যে একদিন তাঁদের উপনিবেশের কোনো জায়গার কোনো অভিজাত নন্দিনীরও পরিচয় হয়ে পড়বে YWCA?কেউ কি স্বপ্নেও ভেবেছিল বংশ গৌরবের বীজ বহন করা কোনো স্বাভিমানী পিতা-মাতার কোল মনোরম করা একমাত্র সন্তানটির ঘরও হবে এই YWCA?

শিল্পবিপ্লবের অবশ্যাম্ভবী পরিণতিতে দুর্গত হওয়া নারীর সাহায্যার্থে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল এই সংগঠনের।ক্রিমিয়ান যুদ্ধ এবং শিল্পবিপ্লব নিগৃহীত করা নারীকে সাহায্য করার সঙ্গে লেডি কিন্নরেইড এবং এমা রবার্টসের নেতৃ্ত্বে পরিচালিত এই সংগঠনের অন্য কতগুলো সুদূরপ্রসারী সঙ্কল্প ছিল।কেবল সাহায্য নয়,নারীর সবলীকরণ নিশ্চিত করার সঙ্গে পরিবর্তন এবং বিবর্তনে নারীর অগ্রণী ভূমিকা নিশ্চিত করে সামূহিক প্রগতি ত্বরান্বিত করা।সাহায্য নিয়ে ক্ষান্ত থাকবে না,সাহায্যের হাত এগিয়ে এগিয়ে দাও।

সময়টা ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিস্তৃ্তির।এর সঙ্গে ছিল লেডি কিন্নরেইডের দেশ-বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ এবং উদ্যম।সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি দান করা সুবিধা এবং ব্যক্তিগত উদ্যম অতি দ্রুত YWCA আন্দোলনের প্রসারে অবদান যোগাল।প্রথমত উত্তর ইউরোপের দেশগুলো,ভারতবর্ষ এবং আমেরিকায় এর সম্প্রসারণ হয়।

১৯৩০ সন পর্যন্ত YWCA এর মুখ্য কার্যালয় ছিল লণ্ডন।এর পরের ক্রমে জেনেভা এবং সুইজারল্যাণ্ড। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় এর মুখ্য কার্যালয় আমেরিকার ওয়াশিংটন ডিসি তে স্থানান্তরিত করা হয় যদিও ১৯৪৩ সনের পুনরায় জেনেভাতে ঘুরিয়ে আনা হয়।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ সর্বস্তরে ছেড়ে যাওয়া ভয়াবহতার মোকাবিলা করে করে এই নীরব আন্দোলনের ভিত অধিক বিস্তৃত এবং সুদৃঢ় হয়।মহাযুদ্ধের সময় এবং এর পরবর্তী সময়ে এই আন্দোলন এইচ আই ভি,এইডস,সাক্ষরতা,নারী সুরক্ষা এবং অধিকার,প্রগতি,দরিদ্রতা নির্মূল,পারস্পরিক সেবার মনোবৃত্তি,সন্তোলিত উন্নয়ন,অস্ত্রের বিপরীত বিন্দুতে শান্তি এবং পরিবেশের মতো জীবন্ত এবং বাস্তব সমস্যাগুলোও নিজের কার্যক্রমনিকার অধীনে আনে।

লেডি কিন্নরেইড এবং এমাই আরম্ভ করেছিল এই বিশ্বাসের যাত্রা’।খ্রিস্টান ধর্মের প্রাধান্যের দ্বারা আরম্ভ হয়েছিল এই যাত্রা।নারী সজাগতা,সামাজিক তথা অর্থনৈতিক বিকাশে নারীর অগ্রণী ভূমিকাকে নিশ্চিত করা এবং নিরাশ্রয়াকে আশ্রয় দেবার প্রাথমিক লক্ষ্যে অগ্রগতির এই আন্দদোলনে খ্রিস্টধর্মে প্রাধান্য এবং অগ্রাধিকার এখনও আছে যদিও দেশ এবং সামাজিক প্রমূল্যভেদে YWCA ই নিজের কার্যপদ্ধতি,অগ্রাধিকার এবং অভিকেন্দ্র পরিবর্তিত অথবা নির্ণয় করতে পারে।

১৮৫৫ সনে কিন্নরেইড এবং এমা আরম্ভ করা আন্দোলন নীরবে এই পর্যন্ত একশো কুড়িটি দেশের সীমা অতিক্রম করে গিয়েছে।‘সেবা গ্রহণ না করে সেবা বিস্তার’করার লক্ষ্যে ১৯ শতিকার এই আন্দোলন নারীর সর্বাত্মক সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য অন্যান্য সামাজিক সমস্যা সমূহকেও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

‘সত্যকে অনুধাবন করা,এই সত্যই তোমাকে স্বধীন করবে।’—এই আন্দোলনের এক নীরব ঐকতান। বোম্বাইতে আন্দোলনের শুরু হয়েছিল এই আহ্বানে—‘প্রতিবেশীকেও ঠিক নিজের মতো ভালবাসতে শিখ।’

বনশ্রীর কপালে নির্ভয়ে বসে থাকা সোনাপোকা তার ছোট্ট শরীরটা সামান্য নাড়াচাড়া করে যেন স্থিতি ঘোষণা করল।তার সোনালি গরিমা নাওমি বুয়ানের দৃষ্টি আকর্ষণ করল।মরা মাছের মতো নির্বাক চোখজোড়ায় মায়াময় আবেদন উজ্জ্বল হয়ে উঠল।কিন্তু কেবলমাত্র কিছুক্ষণের জন্য।হ্যাঁ,মাত্র ক্ষণিকের জন্য।

২৪ এপ্রিল তারিখটা বিশ্ব YWCA দিবস হিসেবে উদযাপন করা হয়।

-২৪ এপ্রিল ! অসমে তখন বৈশাখ বিহুর আয়োজন চরমে।নয় কি বনশ্রী?

শেষের বাক্যটির সঙ্গে সঙ্গে নাওমি বুয়ান বেঞ্চিতে নামিয়ে রাখা তার থলেটা ধীরে ধীরে কাঁধে তুলে নিল।


চলবে ...