শুক্রবার, এপ্রিল ১৯, ২০২৪

অসমীয়া গল্প সৈয়দ আব্দুল মালিকের, 'মরিয়ম পিসির বিয়ে'


স্নেহের রহিম,

আমার ভালোবাসা জেনো। আগামী বুধ এবং বৃহস্পতিবার আমাদের মরিয়ম পিসির বিয়ে।বিয়েতে তুমি আসবে বলে নিশ্চিত ধরে নিলাম। তুমি এলে আমরা সকলেই খুব খুশি হব।পিসিও খুব খুশি হবে।যেভাবেই হোক আসবে কিন্তু।

ইতি

তোমার স্নেহের

মকবুল আহমেদ

একটা বিয়ের নিমন্ত্রণ চিঠির সঙ্গে মকবুলের হাতে লেখা একটা চিঠিও পাঠিয়ে দিয়েছিল। চিঠি দুটো বিশেষ করে মকবুলের নিজের হাতে লেখা চিঠিটা পেয়ে খুব ভালো লাগল।

মকবুলের পিতা মহবুব আহমদ আমাদের বাড়ির পাশের থানার দারোগা ছিলেন।থানা থেকে আমাদের বাড়ি দেড় মাইল দূরে গ্রামের মধ্যে।থানার সামনে দিয়ে আমরা স্কুলে যাওয়া আসা করি,আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি তখনই মহবুব দারোগা আমাদের থানায় বদলি হয়ে এসেছিলেন।পরের দিন তাঁর পুত্র মকবুলকে আমাদের স্কুলে,আমাদের ক্লাসে নাম ভর্তি করাতে এসেছিল।ভর্তির দিন থেকেই মকবুল আমার বেঞ্চে,আমার সঙ্গে বসেছিল।আর সেইজন্য প্রথম দিনেই আমার মকবুলের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল।

তারপর মকবুল আর আমার মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল,স্কুলে আসার সময় যেভাবে মকবুল আমার আসার পথ চেয়ে থাকে,স্কুল ছুটির পরেও আমরা দুজন একসঙ্গে ফিরে আসি,টিফিনের সময় সে আমাকে তাদের বাড়ি নিয়ে যায়,তার মা এবং পিসি তখন তাকে যা খেতে দেয় আমাকে ও তাই দেয়।পিসিকে সে মরিয়ম পিসি বলে ডাকত,তাই দেখে আমিও মরিয়ম পিসি বলে ডাকতাম।মরিয়ম পিসি আমাকে বড় ভালোবাসতেন।

তবে মকবুলের পিতা মহবুব দারোগাকে আমি ভীষণ ভয় করতাম।মানুষটা বড় শক্তপোক্ত ছিলেন,কথা প্রায় বলেনই না এবং সব সময়েই পুলিশের সাজপোষাক পরে থাকেন।মকবুলের সঙ্গে প্রায়ই এসে আমি থানার পেছনদিকে থাকা ছোট ঘরটাতে ঢুকে চা জলপান খেয়ে যাই যদিও তিনি আমাকে কোনোদিন একটা কথাও জিজ্ঞেস করেননি,অবশ্য কখন ও ধমক দেন নি বা বকাবকি করেননি।তবু মহবুব দারোগাকে আমার বেশ ভয় করত।

তবে প্রথমে মকবুলের মা এবং মরিয়ম পিসিকে আমার ভয় করলে ও পরে আমার ভয় চলে গিয়েছিল।মকবুলের মা কিছুটা অসুস্থ ছিলেন এবং বেশিরভাগ সময় বিছানায় শুয়ে থাকতেন।মরিয়ম পিসিই বেশিরভাগ সময় আমাদের চা সরবত করে দিতেন।

মরিয়ম পিসি খুবই স্নেহশীলা ছিলেন। তাঁকে সবসময় আমাদের বাড়ি নিয়ে যেতে ইচ্ছা করে।তবে আমরা তো খুবই দুঃখী।আমাদের বাড়ি গ্রামে,ঘরগুলি খড়ের,ঝুপড়ি ঘর।মা যদিও সবসময় লেপেপুছে সুন্দর করে রাখে,বৃষ্টি এলেই ঘরের ভেতর জল পড়ে। আমদের বাড়িতে দারোগার ঘরের মতো চেয়ার টেবিলও নেই,কাপড়-চোপড় ও নেই।সেইজন্যই বাড়িতে ডাকব ভেবেও ডাকিনি।

তারপর একদিন মহবুব দারোগা আমাদের থানা থেকে বদলি হয়ে গেলেন।মকবুল,তাঁর ভাই, বোন এবং মরিয়ম পিসিকে ও সঙ্গে নিয়ে গেলেন।

যাবার দিন আমার খুব খারাপ লেগেছিল।আমি কেঁদে ফেলেছিলাম।সেদিনই মকবুলের বাবা মহবুব দারোগা আমাকে কোমল কণ্ঠে বলেছিলেন,‘কেঁদ না।হাইস্কুল পাশ করে যখন কলেজে যাবে তখন মকবুলকে আবার সঙ্গী হিসেবে পাবে।

মরিয়ম পিসিরও সেদিন কাঁদ কাঁদ অবস্থা হয়ে গিয়েছিল। তারপর তারা চলে গেল।ক্লাস নাইনে প্রোমোশন পাওয়ার পরে আমার আর পড়া হল না।চাষ বাসের কাজে লেগে পড়তে হল।বই পত্র কেনার জন্য,ফীস দেবার জন্য এবং কাপড় চোপড় কেনার জন্য টাকার যোগাড় করতে পারলাম না।আমাদের খুব একটা জমি ছিল না।তবু কিছুদিন চাকরির খোঁজ করে না পেয়ে চাষের কাজেই মন দিলাম।

মকবুলরা আমাদের এখান থেকে চলে যাবার কিছুদিন পরে চাকরির খোঁজে আমি একবার ওদের ওখানে গিয়েছিলাম।শহরের এক প্রান্তে ওদের বাড়ি।সেখানে ওদের বাড়িটাই সবচেয়ে বড় এবং সুন্দর।মহবুব দারোগা সস্তায় জমি কিনে রেখেছিলেন,সেই জমিতে ঘর বানান,আমি দুয়েকজনকে জিজ্ঞেস করতেই মহবুব দারোগার বাড়িটা আমাকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন।

মকবুল সেই সময় বাড়ি ছিল না।তবে মরিয়ম পিসি ছিলেন।তিনি আমাকে আগের মতোই আদর যত্ন করে চা ভাত খাইয়ে পাঠিয়েছিলেন।পিসি বলেছিলেন আমি নাকি খুব কালো হয়ে গেছি।

হাইস্কুল পাশ করে শিলঙে পড়তে যাবার পরেও মকবুল আমাকে মাঝে মধ্যে চিঠিপত্র লিখত...

মরিয়ম পিসির বিয়ের চিঠি পেয়ে খুব খুশি হলাম,কথাটা মাকে বললাম।মা বললেন-‘এত বড় মানুষটা তোকে যে ভুলে যায়নি-বিয়েতে তুই যেভাই হোক যা। কত আশা করে তোকে ডেকেছে।

আমিও মরিয়ম পিসির বিয়েতে যাব বলে ঠিক করলাম।সকালে রেলে করে যাব,বিকেলের রেলগাড়িতে ফিরে আসব।আসা যাওয়ায় খুব বেশি হলে দুটাকা খরচ হবে।অন্য কোনো খরচের তো দরকার নেই।দারোগার ঘরের বিয়েতে খাবার দাবারের কোনো চিন্তা নেই।

ঈদে একটা পায়জামা কিনেছিলাম।এখনও নতুন রয়েছে।পায়জামা বিশেষ কোনো অনুষ্ঠান থাকলে তবেই পরা হয়।আমাদের গ্রামের মফিজের বিয়ের সময় একটা কামিজ কিনেছিলাম।সেটাও খুব বেশি পরিনি-এই দুটো কোনো বিশেষ অনুষ্ঠানে পরার জন্য যত্ন করে বাক্মে তোলা আছে।ঈদ বা বিয়ে সাদিতে পরি,এইসব দামি জামা কাপড় সবসময়ে পরার জন্য নয়।

গেঞ্জিটাতে দাগ লেগেছে যদিও ধুয়ে নিলে পরা যাবে।তাছাড়া কামিজের নিচে থাকবে যখন ফাটা হলেও কেউ বুঝতে পারবে না।শহরের বিয়ে-তাতে আবার মহবুব দারোগার মতো ধনী এবং বড় মানুষের ঘরের বিয়ে এবং মরিয়ম পিসির মতো একজন স্নেহশীলা মেয়ের বিয়ে,বিয়েতে ডেকেছে যখন পোশাক আশাক ভালো দেখে পরে যেতে হবে।

আমার জুতো নেই।জুতোর অনেক দাম।কেনার মতো টাকা নেই।তাছাড়া এমনিতেও আমি জুতো পরিনা।হাইস্কুলে থাকার সময়েই এক জোড়া কাপড়ের জুতো কিনেছিলাম,শীতের সময় রাতের বেলা সেটা পরে পরে শেষ করেছি।তারপর আর জুতো কিনিনি।সেভাবে দরকারও পড়েনি।কিনতেও পারিনি।তাছাড়া জুতোর দামও ইতিমধ্যে অনেক বেড়ে গেছে।কিন্তু মরিয়ম পিসির বাড়িতে,তাঁর বিয়েতে জুতো না পরে যাওয়া যায় না।তাতে শহরের বিয়ে।খালি পায়ে শহরের বিয়েতে যাওয়া যায় না,মান সম্মানের কথা।

মায়ের সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বললাম।মা বললেন-‘আমার হাতে মাত্র তিন টাকা চার আনা আছে।তা দিয়ে একজোড়া জুতো পাওয়া যাবে কি?তাছাড়া রেলের ভাড়াও তো লাগবে।

অবশেষে ঠিক করলাম যে নতুন জুতো কিনব না।আমাদের গ্রামের হাইদর আলি দাদার বিয়েতে এক জোড়া কালো দামি জুতো কিনেছিল।অনুরোধ করলে একদিনের জন্য ঐ জুতো জোড়া ধার নেওয়া যাবে।বিয়ে থেকে ফিরে এলেই জুতো জোড়া ফিরিয়ে দিতে হবে।

হাইদর আলি রাজি হল।গ্রামে অনেকদিন কোনো বিয়ে সাদি ছিল না,জুতো জোড়া যত্ন করে তুলে রাখা আছে।আমাকে বিয়েতে পরে যেতে দিতে কোনো আপত্তি নেই।

আমি খুশি হলাম।বললাম,‘তুই কোনো চিন্তা করিসনা।আমি বিকেলে ফিরে এসেই জুতো জোড়া ফিরিয়ে দেব।’

হাইদর বলল,‘আচ্ছা বিকেলে ফিরিয়ে না দিলেও হবে।তুই খুব একটা পরিস না,শহরের রাস্তায় জুতোর গোড়ালি খুব দ্রুত ক্ষয়ে যায়।’

আমি বললাম,‘আমি কি আর সারাদিন জুতো পরে থাকব?এখান থেকে তো আর পরে যাব না।ওখানেও রেলস্টেশন থেকে বিয়ে বাড়ি পর্যন্ত পরে যাব,ফেরার সময় স্টেশন পর্যন্ত পরে আসব।আমরা কি আর জুতো পরা মানুষ-’

‘এখনই নিয়ে যাবে কি?’

‘এখনই নিয়ে কি করব?চোর-ডাকাতের ভয়-আমাদের বাড়ি ঘরের যা অবস্থা।যাবার দিন এদিক দিয়ে যাবার সময় নিয়ে যাব।তুই বের করে রাখিস।‘আমি বললাম

হাইদর রাজি হল।সকালের রেলে যাব আর বিকেলের রেলে ফিরে আসব।মা মকবুলদের জন্য দুটো পিঠে ভেজে দিল,দুয়েকটি নাড়ু করে দিল।আমি লাগবে না বলেছিলাম।

মা বলল,বিয়েতে কি খালি হাতে যাবি নাকি?তার মধ্যে বড় লোকের বাড়ির বিয়ে।আমরা এছাড়া আর কি দেব?এগুলিই নিয়ে যাবি।‘

মা রাতেই পুঁটলি বেঁধে রেখেছিল।রাতে আমার ভালো ঘুম হল না।হ্রের দিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে স্নান করে পায়জামা আর কামিজ পরে,মা বেঁধে দেওয়া নাড়ু আর পিঠের পুঁটলিটা হাতে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম।

মা একটা ছেঁড়া কাপড় দিয়ে বলল,এত বড় বাড়ির বিয়ে,খালি হাতে তো আর ফিরে আসতে দেবে না।বিয়ের কিছু চিহ্ন নিশ্চয় দেবে,এতে করে বেঁধে আনিস।

হাইদরদের বাড়িতে ঢুকে জুতোজোড়া নিলাম। মায়ের দেওয়া ছেঁড়া কাপড়টা দিয়ে পেঁচিয়ে বগলের নিচে ভরিয়ে নিয়ে স্টেশনের দিকে এগিয়ে চললাম,এক মাইল দূরে স্টেশন।...

শহরের স্টেশনে নেমে আমি প্রথমে ভিড় কমার জন্য কিছুক্ষণ এদিক ওদিক তাকিয়ে কাটালাম। তারপর যখন মানুষগুলি এক এক করে যে যার গন্তব্যে চলে গেল তখন স্টেশনের জলের কলটার কাছে গিয়ে হাত মুখ আর বিশেষ করে পা-দুটি ভালো করে ধুয়ে নিলাম।তারপর জলের কলের কাছে থাকা কাঠের বেঞ্চটাতে বসে পড়লাম-পা দুটো শুকোনোর জন্য।ভেজা পায়ে জুতো পড়লে জুতোজোড়া খারাপ হয়ে যাবে।

তারপর ধীরে ধীরে পুঁটলিটা খুলে জুতোজোড়া বের করলাম।জুতোজোড়া একেবারে নতুন রয়েছে-কালো রঙের চামড়া চকচক করছে।আমার দিকে কারও ঞ্জর নেই। স্টেশনের লোকগুলি যে যার নিজের কাজে ব্যস্ত।আমার বেশ ভালো লাগল।জুতোজোড়া সামনে এনে আমি পরার চেষ্টা করলাম।আমি যেন সব সময়েই জুতো পরি এরকম একটা ভাব নিয়ে জুতোর দিকে না তাকিয়ে জুতোজোড়ায় পা ঢোকাতে চেষ্টা করলাম।কিন্তু পায়ের সামনের দিকটা ঢোকার পরে আর যাচ্ছে না।এবার কুঁজো হয়ে ভালো করে জুতোর ভেতরটা দেখে ঢোকাতে চেষ্টা করলাম,অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করলাম,না কিছুতেই ঢুকছে না।জুতোর ভেতরটা ভালো করে দেখলাম,না কিছুই নেই।ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম হাইদরের জুতোজোড়ার চেয়ে আমার পা এক আঙ্গুল বড়।মনটা খারাপ হয়ে গেল।

ডান পায়েরটা রেখে বাঁ পায়েরটা পরার চেষ্টা করলাম।হবে বলে মনে হল-কিন্তু না।জুতোজোড়া আমার পা থেকে এক আঙ্গুল ছোট।একবার এটা,আবার ওটা পায়ে ঢোকাতে চেষ্টা করলাম-একটু টানাটানি করলে জুতোজোড়া কিছুটা বড় হয় নাকি সে চেষ্টাও করে দেখলাম,পা দুটো কোনো উপায়ে জুতোজোড়ার মতো ছোট করা যায় নাকি সে চেষ্টাও করে দেখলাম।

কিছুই হল না।জুতো জুতোর জায়গায়,পা পায়ের জায়গায় রইল।খুব খারাপ লাগল,হায়দরের বাড়িতে যদি একবার জুতোজোড়া পরে দেখতাম।অনেক চেষ্টা করেও জুতোজোড়া পরতে না পেরে হতাশ হলাম।শেষপর্যন্ত জুতোজোড়া ছেঁড়া কাপড় দিয়ে পুঁটলি বেঁধে নিলাম।

কামিজটা ভালোই,পায়জামাটাও খারাপ নয়।জুতোজোড়া যদি পায়ে ঠিক হত।বড় আনন্দের সঙ্গে মরিয়ম পিসির বিয়ে খেয়ে ফিরে যেতে পারতাম,মকবুল এত আশা করে নিমন্ত্রণের চিঠি পাঠিয়েছিল।ওর বাবাও বিয়েতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল।এতটা দূর এসেও ছিলাম।কিছুটা গেলেই বিয়ে বাড়ি।ছিঃ।আমার পায়ের মাপের জুতোজোড়া যদি কোথাও থেকে জোগাড় করতে পারতাম।এখন কী করব?খালি পায়েই বিয়ে বাড়ি চলে যাব কি?আমাকে ওভাবে দেখতে পেলে লোকজনই বা কী বলবে,মকবুলই বা কী ভাববে।মরিয়ম পিসি তাঁর বিয়েতে আমাকে খালি পায়ে দেখলে নিশ্চয় খারাপ পাবে।

বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম।চারপাশে তাকালাম।এখন আর গাড়ি নেই।আমাদের দিকের গাড়ি বিকেলের দিকে রয়েছে।এখন আমি কি করব?আবার বসলাম,পুঁটলিটা খুলে জুতোজোড়া বের করে নিলাম।আশা করি এবার কোনোভাবে জুতোজোড়া পায়ে হয়ে যাবে।পুনরায় জুতোজোড়া পায়ে ঢোকানোর চেষ্টা করলাম।

না,এত সময়ের মধ্যেও জুতোজোড়া বিন্দুমাত্র বড় হল না,আমার পা দুটিও ছোট হয়নি।জুতোজোড়া যদি ঢিলে হত তাহলেও কোনোভাবে পরতে পারতাম।হল কিনা টাইট।পুনরায় ছেঁড়া কাপড় দিয়ে জুতোজোড়া বেঁধে নিলাম।জুতোজোড়াকে আমার শল্রু বলে মনে হতে লাগল।এবার বেঞ্চ থেকে উঠলাম।বগলের নিচ থেকে জুতোর পুঁটলি এবং হাতে নাড়ু-পিঠার পুঁটলিটা নিয়ে ধীরে ধীরে বিয়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে চললাম।

কিছুক্ষণের মধ্যেই মকবুলদের বাড়ির কাছে পৌছে গেলাম।খুব সুন্দর গেট বানিয়েছে-বিশাল কুঞ্জ।বাড়ির সামনে অনেক মোটর গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে।অনেক লোক জন হেসে খেলে যাওয়া আসা করছে।আমি তাকিয়ে দেখি প্রত্যেকেই সুন্দর সুন্দর জুতো পরেছে।মেয়েরা এবং মহিলারা স্যাণ্ডেল পরেছে।খালি পায়ে কেউ আসেনি।

মকবুলদের বাড়ির কিছু দূরে পথের পাশে পাকা পুলটাতে আমি বসলাম আর পুঁটলি দুটো নামিয়ে পাশেই রাখলাম।আমার খুব ক্লান্ত লাগছিল।গতরাতে ভালো করে ঘুম না হওয়ার জন্যই চোখদুটি জ্বালা করছিল।ভীষ্ণ রোদ ছিল।তবে পুলটার পাশে গাছের নিচে ছায়ায় বসেছিলাম।

আমার খুব তেষ্টা পেয়েছিল।বিয়েবাড়ির দিকে তাকিয়ে রইলাম।মাঝে একবার মকবুলকেও দেখতে পেলাম।মকবুলের বাবাকেও দেখতে পেলাম,কিন্তু মরিয়ম পিসিকে কোথাও দেখতে পেলাম না।পেছনে সজ্জিত বিয়ের মণ্ডপে মরিয়ম পিসিকে নিয়ে গেছে বোধ হয়।কনের সাজে পিসিকে নিশ্চয় খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।আমার ক্ষুধা পেয়েছিল।কিন্তু আমার মোটেই ঊঠে যেতে ইচ্ছা করছিল না।এমনিতেই ক্লান্তিতে হাত পা গুলি সব ছিঁড়ে পড়বে বলে মনে হচ্ছিল।

রঙবেরঙের মোটর,রিক্মা,স্কুটার,মোটর সাইকেল,রঙবেরঙের স্যুট পেন্ট,শাড়ি,ব্লাউজ,ফ্রক,রঙবেরঙের নানান মানুষ এসেছে হাসছে কথা বলছে উঠছে বসছে ভেতরে যাচ্ছে,বিদায় নিচ্ছে-হুলুস্থূল হইচই ব্যস্ততা।

আমি পুলটাতে বসে রিলাম,একা-নীরবে।আমার দিকে কেউ তাকাচ্ছে না।মাঝে মধ্যে আমার পা দুটির দিকে তাকাই।ধুলো লেগে বড় নোঙরা হয়েছে।মাঝে মধ্যে জুতো বেঁধে আনা পুঁটলিটার দিকে তাকাই-আমার পায়ে না হওয়া জুতোজোড়া ওতে রাখা আছে।আমার খু ক্ষুধা পেয়েছে বলে মনে হল।হোটেলে খাবার মতো পয়সা নেই।পকেটে কেবল ফিরে যাবার রেলভাড়াটা রয়েছে।

ধীরে ধীরে আমি মরিয়ম পিসির জন্য মা পাঠানো পিঠে আর নাড়ুর পুঁটলিটা খুলে ফেললাম।এগুলিতে ভাগ বসাতে খারাপ লাগল।কিন্তু ধীরে ধীরে নিজের অজান্তেই পুঁটলির ভেতর থেকে একটা পিঠে বের করে প্রথমে হাতে রাখলাম,তারপর ধীরে ধীরে মুখে পুড়ে দিলাম।

চারপাশে তাকালাম। আমার দিকে কেউ তাকিয়ে নেই।একটা চোরের মতো আমি পুনরায় পুঁটলিটাতে হাত ঢুকিয়ে আরও একটা পিঠে এনে মুখে দিলাম।বেশি করে চিবোলে কেউ শুনে ফেলবে বা দেখে ফেলব বলে মনে হল।কিছুটা চিবিয়েই পিঠেটা গিলে ফেললাম।তখনই বিয়ে বাড়িতে আরও বেশি হুলুস্থূল শুরু হল।অনেক মোটর গাড়ি,কয়েকটা বাস এসে দারোগার বাড়ির সামনে দাঁড়াল।বিয়ের কুঞ্জে দৌড়াদৌড়ি লেগে যায়।বর আর বরযাত্রী এসে গেছে।আমি বরকে বরণ করে নিয়ে যেতে দেখলাম।পেছনের দিকে কুঞ্জ থেকে মরিয়ম পিসির কান্না শোনা গেল বলে মনে হল।কেউ আমাকে দেখছে না।সবাই বরযাত্রীদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।সবাই মিলে হইচই করছে।বরকে কুঞ্জে নিয়ে যাওয়া হল।লোকজন বরকে ঘিরে পেতে রাখা কার্পেটে বসল।কেউ আতর ছিটোল,কেউ বা গোলাপ জল।বরের ঘর আর কনের ঘরের লোকজনদের মধ্যে পান সুপুরির বিনিময় হল।গাছের ছায়ায় পথের পাশের পুলটাতে বসে আমি কেবল তাকিয়ে রিলাম।আমার হাত পুঁটলি থেকে এক এক করে পিঠে এনে মুখে ভরিয়ে দিতে লাগল।আমাকে কেউ দেখছে না।মকবুল বা মহবুব দারোগা কেউ আমাকে দেখছে না।

আমি বসে বসে মরিয়ম পিসির বিয়ে দেখতে লাগলাম।বসে বসে আমার বোধ হয় ঘুম পেয়ে গেছিল।একটা হইচই শুনে জেগে উঠলাম।দেখনাম কনেকে বের করে এনে গাড়িতে তুলছে।মেয়ে এবং মহিলারা কান্নাকাটি করছে।

এবার আমি দেখলাম মরিয়ম পিসিকে গাড়িতে তোলার পরে মকবুল ও হাউমাউ করে কাঁদছে আর কিছুটা দূরে মহবুব দারোগাও কাঁদকাঁদ মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।কিছুক্ষণের মধ্যেই মরিয়ম পিসিকে নিয়ে বরপক্ষের গাড়ি ধুলো উড়িয়ে চলে গেল।

আমার গাড়ির সময় হয়ে গিয়েছিল।পুল থেকে নেমে ধীরে ধীরে স্টেশনের দিকে হাঁটতে লাগলাম।কাপড়ের পুঁটলি বাঁধা জুতোজোড়া বগলের নিচে রেখে পিঠে আর নাড়ু বেঁধে আনা পুঁটলিটা পুলের নিচে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম।

জুতোজোড়ার গোড়ালি এতটুকু ক্ষয় হয়নি।হাইদর কিছু মনে করবে না।আমারই জুতোজোড়া একটু ভারী ভারী বলে মনে হচ্ছিল।

-----------

লেখক পরিচিতিঃ অসমিয়া কথা সাহিত্যের অন্যতম রূপকার সৈয়দ আব্দুল মালিক ১৯১৯ সনে অসমের শিবসাগর জেলার নাহরণিতে জন্মগ্রহণ করেন।যোরহাট সরকারি হাইস্কুল থেকে পাশ করে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অসমিয়া সাহিত্যে এম এ করেন।পরবর্তীকালে যোরহাট জেবি কলেজে অধ্যাপনা করেন।লেখকের গল্প সঙ্কলন গুলির মধ্যে ‘পরশমণি’,শিখরে শিখরে’,শুকনো পাপড়ি’বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।‘অঘরী আত্মার কাহিনী’উপন্যাসের জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন।