বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ১৮, ২০২৪

অধিকার


তনু দাঁড়াল । তার প্রথম চোখে পড়ল যে বাড়িটি সেটা একটি ছোট্ট টিলার ওপর । ওই টিলাটায় আরো বাড়ি আছে । যে-বাড়িটার দিকে ওর প্রথমেচোখ পড়েছে সেটা সামনের দিকে।

এই শৈলশহরে সব আবাসস্থলই টিলার ওপর নয়ত পাহাড়ের গায়ে । তনুর অফিসটাও তো একেবারে পাহাড়ের মাথায় । বাইক বা কার ছাড়া অফিস যাওয়া কষ্টকর । বাইক কেনার জন্য লোনও পেয়ে গেছে তনু । সে ভেবেছিল পায়ে হেঁটেই ওঠানামা করবে । কিন্তু কলিগরা ওকে বোঝাল , ' নিয়ে নিন মশাই একেবারে কম ইণ্টারেস্টেপাবেন , এই চান্স আর আসবেনা । ' নিয়ে নিল । এখন ভাড়া ঘর পাওয়ার অপেক্ষায় । ঘরটা পাওয়া গেলেই কিনেনেবে।

সত্যি , এই পাহাড়ি শহরে হেঁটে চলাফেরা করা কষ্টকরই বটে । তনুকে তো এই বয়সেই বুড়োদের রোগে ধরে ফেলেছে । চড়াইয়েবেশি হাঁটলেই বুকে একটা অস্বস্তিকর চাপ ধরে । এই আজকের সকালে হেঁটে হেঁটেএখানে উঠে এসেছে , ঠান্ডার মধ্যেও কপালে ঘাম জমে একসার। বূকের ভেতরের চাপটার রেশ এখনও রয়ে গেছে ।

একটু জিরিয়ে নিয়ে তনু একটা সিমেন্ট বাঁধানো সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে শুরু করে । সিঁড়ির শেষ ধাপ পেরিয়েই সেই বাড়িটা । বাড়িটার যে-মুখে দাঁড়িয়ে আছে তনু সে-দিকটা বাড়িটার সামনের দিক না পেছনের বোঝা যায় না । শুধু সংকীর্ণ সিমেন্ট বাঁধানো গলিপথ একটা চোখে পড়ে তার । ওই গলিপথ দিয়ে ভিতরে যাওয়া যায় । দোনামনায় পড়ে যায় তনু । ওই গলিপথে ঢুকবে কি ঢুকবে না । কিন্তু রেস্ট হাউস থেকে যে-জেদ নিয়ে বেরিয়েছে সে , সেটা তো পূরণ করতেই হবে । আর অন্য কিছু ভাবল না সে । ঢুকে পড়ে ওই গলিপথে । এগিয়ে যায় । এগিয়ে যেতে যেতে এমন এক জায়গায় গিয়ে দাঁড়াতে হল তাকে সেটা একটা ঢালু উঠোন । উঠোনের চারদিকে কতোগুলো ঘর । ঘরগুলো পাকা হলেও দেখতে মনে হয় লঙ্গরখানা । উঠোনের মাঝখানে বসে চাল ঝাড়ছিলেন এক প্রান্ত-যৌবনামহিলা । তনুকে দেখে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করেন , ক্যা ক্যা , আন্নে ক্যা কন চাই , কিয়েল্লাই আইচেন ?

তনু কোন জবাব খুঁজে পায় না । ভ্যাবাচ্যাকাখেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে । তনু বোঝে মহিলা বিদঘুটে কোন বাংলা উপভাষায় কথা বলছেন । চট্টগ্রামের নয়তনোয়াখালিরঅথবা ঢাকাইয়ার , শ্রীহট্টের নয় । তনু নিজে শ্রীহট্টভাষীমানুষ । বলতে না-পারলেও কিছুটা বোঝে ।তনু একটু ধাতস্থ হয়ে জবাব দেয়, আমার একটা ভাড়াঘরের দরকার ।

মহিলা আরওএকটু কাছে এসে বলে ওঠেন , ক্যা কইলেন , ক্যা কইলেনে , বুজি নাই।

ওই মুহূর্তে বাঁপাশের একটি ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন আধবয়েসি এক ভদ্রলোক । ভদ্রলোকেরসব চুল পাকা । পাকা হলেও ভদ্রলোক বুড়ো নন । কোন কারণে তাঁর চুলগুলো অসময়ে পেঁকে গেছে । ভাদ্রলোকের গায়ের রং কাল , চোখে চশমা । শরীরের গঠন নাদুস-নুদুস । ভদ্রলোক এগিয়ে এসে মহিলাকে বাধা দিয়ে বলে ওঠেন , রও রও আমি কথা কই , তুমি যাও চাইন...

বলতে বলতেভদ্রলোক এগিয়ে এলেন তনুর কাছে , তারপর চোখেমুখে অনেকটা জিজ্ঞাসারঢেউ ফুটিয়ে বলেওঠেন , আপকো কেয়া চাইয়ে ?

তনু ভিরমি খেল একটা । ভদ্রলোক তাকে ভেবেছেন অবাঙালি । সে তো ওই মহিলার ভাষা শুনে বুঝে গেছে এরা বাঙাল । সে বাংলাতেই জবাব দেয় , আমার একটা ভাড়াঘর চাই দাদা ।

তনুর কথা শুনে চমকে ওঠেন ভদ্রলোক ।

বলেন , অ আন্নে বাঙালি , আন্নের মুখটা দেইখ্যা আমার সন্দেহ হইছিল কিন্তু , আন্নে বাঙালিই হইবেন , তবুও ...

বাকিটুকু না বলে খ্যাক খ্যাক করে হেসে ফেলেন তিনি। তারপর হাসি থামিযে এবার অনেকটা জিঞ্জাসার সুরে বলেন , আন্নে কী কইলেন চাই , ঘর লাগে ?

তনু ছোট্ট করে জবাব দিল , হ্যাঁ ।

ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গে সক্ষম-অক্ষমের কথা প্রকাশ না করে স্থির তাকিয়ে থাকেন তনুর দিকে । তারপর হঠাৎ তনুর ডান হাতটাধরে বলে ওঠেন , আয়েন আয়েন আগে আইস্যা এট্টু বয়েন আমার গরে ...

বলতে বলতে তনুর হাতটা ধরে আলতো টানতে শুরু করেন তিনি । তনু অনেকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ভদ্রলোককেঅনুসরণ করতে থাকে । তনুর হাতটি তখনও ছাড়েননি তিনি। তাঁরপিছু যেতে যেতে তনুর দু-চোখ হঠাৎ আটকে যায় ও পাশের আরেকটি ঘরের দরজার দিকে । ওই দরজার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এসেছে একটি কৌতূহলী নারীমুখ । ওই মুখটি ওর দিকেই তাকিয়ে আছে । ও তাকাতেই মুখটা সরে যায় ।

ভদ্রলোক তনুকে নিয়ে বসালেন তাঁর বসার ঘরে । তারপর বলতে শুরু করলেন , অ্যাত্ত সক্কাইল সক্কাইল আইচেন ঘরের খুঁজে , আন্নে বিপদেই পইচ্চেন মনে হয় ...

বলতে বলতে ম্রিয়মাণ হাসেন তিনি , তারপর আশ্বাসের ভঙ্গিতে বলেন , অইব , অইব চিন্তা করিয়েন না ...

বলতে বলতে ভদ্রলোক এবার সামনের কাঠের চেয়ার একটিতে গিয়ে বসেন । চেয়ারটার উল্টো দিকে রয়েছে একটি পুরানো কাঠের টেবিল । টেবিলের ওপর রয়েছে একটি শক্তপোক্ত বেতের ছড়ি ।

--- শুনে খুশি হলাম ।

তনুর চোখেমুখে ফুটে ওঠে হৃষ্টতা ।

ভদ্রলোক হাসলেন তনুর কথা শুনে । তারপর জানতে চাইলেন , আন্নের মন্নিং টি হয় নাই নিচ্চয় ? মুখডা শুকনা শুকনা লাগতাছে ।

তনু জবাব দেয় , ঠিকই বলেছেন , সকাল সকাল কেই বা চা বানিয়ে খাওয়াবে , আমি তো ---

--- অ : আন্নে বাচিলার , ঠিক আছে , ঠিক আছে , ইখানে হগ্গলডাই পাইবেন , আইজ থিক্যা আপনে আমাগ পেয়িং গেস্ট ....

বলতে বলতে আবারখ্যাক খ্যাক করে হেসে ওঠেন ভদ্রলোক । তারপর একটু বিরতি নিয়ে জিজ্ঞেস করেন তনুকে ---

--- এইবার কন আন্নেএই তুরা পাহাড়ে কী কাম লইয়া আইছেন ?

তনু জবাব দেয় , আমি এখানে সরকারি কাজে বদলি হয়ে এসেছি জনস্বাস্থ্যবিভাগের অফিসে এক সপ্তাহ হয়ে গেল । এ কদিন সরকারি রেস্ট হাউসেই কাটিয়েছি । কিন্তু একটা পার্মানেন্টভাড়াঘর তো চাই । তাই আজ সকালেই একটা জেদ নিয়ে বেরিয়ে পড়েছি , একটা ভাড়াঘরের ব্যবস্থা করেই তবে ফিরব । ঘর খুঁজতে বেরিয়ে আপনার এই বাড়িটাই প্রথমে চোখে পড়ল , ঢুকে পড়লুম যা হয় হবে এই ভাবনা নিয়ে ।

--- ঠিক কইচ্চেন , কুনো ভুল করেন নাই , এই সহদেব গুণের কাছে আইয়া কেউ বিমুখ হইয়া ফিরে নামনে রাইখ্খেন , আমি তুরা পাহাড়ে পত্তিরিশ বছরে ধইরা আছি , আমারে হগ্গল ব্যাটাই চিনে....চিন্তা করিয়েননা , হইব , কিছু একডা করুম আন্নের লাইগা , আগে চা খাইয়া লন , আমিও খাই নাই ...

বলতে বলতে ভদ্রলোক অর্থাৎ সহদেব গুণটেবিলের ওপর রাখা বেতের ছড়িটা নিয়ে সজোরে একটা ঠোক্কোর দিলেনটেবিলের ওপরেই ।

ওই ঠোক্কোরেরএকটু বাদেই এসে হাজির হলেন , এ বাড়িতে ঢুকেই যে মহিলাটির সঙ্গে তনুর দেখা হয়েছিল , তিনি । তনু আশ্চর্য হয়ে যায়সহদেবের এই কাণ্ডে ! এ তো দেখি টোল-মাস্টারের মতো , বেতের শব্দ শুনিয়ে পড়ুয়াদের সতর্ক করা । সহদেব গুণপরিচয় করিয়ে দিলেন মহিলার সঙ্গে , এইডা আমার পথথম বউ, আমি হেরে খ্যালা কইয়াই ডাকি , আন্নে হেরে বড় বৌদি কইয়াই ডাইক্কেন ...

বলতে বলতে আবার ওই খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠলেন তিনি ।

হাসিটা থামিয়ে তারপর আগের মতো আবার ওই কাণ্ডটি করলেন সহদেব । ওই বেতের ছড়িটা নিয়ে এবার সজোরে দুটো ঠোক্কোর দিলেন টেবিলের ওপর । ওই জোড়া ঠোক্কোরেরসঙ্গে সঙ্গে হাজির হয় দেহাতি আদলের তরুণী বউ একজন । তনু দুচোখ সটান করে লক্ষ করে , এই বউটিই ওই কৌতূহলী মুখটির মালিক , যে মুখটিকে কিছু আগে সে নিমেষের জন্য দেখেছিল দরজার আড়ালে । এবার দেখল সশরীরে । সহদেব গুণপরিচয় করিয়ে দেন , এইডা আমার দিত্তিয় পইক্ষের বউ , আমি হেরে খুকুমণিকইয়া ডাকি , আন্নে হেরে ছুডো বউদি কইয়া ডাইকেন ---

বলতে বলতে এবার খ্যাক খ্যাক করে হাসলেন না সহদেব , হাসলেন বেশ আঁটোসাঁটো ভাবে ।

তনু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে খুকুমণির দিকে । এ তো সহদেবের মেয়ের বয়সি । পূর্ণ যৌবনা । মনে মনে ভেবে অবাক হয় তনু , সহদেববাবু নিশ্চয় কোন কন্যাদায়গ্রস্ত অসহায় পিতার সম্বলহীনতার সুযোগ নিয়ে এই মেয়েটিকে বিয়ে করেছেন । এক বউয়ে আশ মেটেনি , তাও আবার হাঁটুর বয়সি মেয়ে । খুকুমণি লজ্জারাঙা চোখে ঘন ঘন দেখে ওকে । পর মুহূর্তে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে সতর্ক হয়ে নিজের ভেতর ফিরে যায় । সহদেবের দিকে ফিরে তাকায় ।

সহদেব এবার ওঁর প্রথম বউ খেলাকে আদেশের সুরে বলেন , এনারে চা দে আগে , ভালো কইরা বানাইস , এক গেলাস ভত্তি কইরা দেইস , সক্কালের চা ত , আর লগে দেইস আমাগো পিটেণ্ট মুড়কি আর চিড়ার মুয়া...

বলতে বলতে ওই ছড়িটা দিয়ে আবার একটা ঠোক্কোর লাগালেন টেবিলটায় তিনি ।

ওই ঠোক্কোরেরসঙ্গে সঙ্গে খেলা-খুকুমনি দু জনেই বেরিয়ে গেল ।

তনু আশ্চর্য হয়ে আবার ভাবতে বসে , এ তো দেখি একেবারে হিট্লারি কায়দায় শাসন করা । বউ দুটোকে যেন কলের পুতুল করে রেখেছেন সহদেব ।

সহদেব কথার খেই ধরেন , আমি মুড়ি চিড়ারব্যবসা করি গাড়োগো এইপাহাড়ে । ইখানকার বাঙালিগুলারে আমিই মুড়ি খাওয়াইয়া বাঁচাইয়া রাখছি । আর গাড়োগুলানরেমুড়ি খাইতে শিখাইছি ...

বলতে বলতে আবার ওই খ্যাক খ্যাক করে হাসতে থাকেন সহদেব । এরপর তাঁর ওই স্বভাবসিদ্ধহাসিটির রেশ মুখে রেখে বলে ওঠেন , আন্নের নামডাই ত জানা অইল না বাবু ---

তনু হাসতে হাসতে বলে , তনু , তনু হালদার ।

--- অ: তাইলে আন্নে হিন্দুই আছেন , দ্যাশ কই আছিল ?

---- শিলং ।

---- শিলং আন্নের দ্যাশ না , ওইখানে আন্নে থাকেন , দ্যাশ দ্যাশ , মানে আদিবাড়ি , নোয়াখালিনা চাটগাঁও , না সিলেট , না ঢাকা ?

--- অ: অগুলোজানি না । আমার শিলংয়েই জন্মকর্ম , পড়াশুনা ---

--- আরে আন্নের বাপ-মা ঘরে কী ভাষায় কথা কয় ?

তনু একটু সময় নিয়ে জবাব দেয়, সিলেটিতে ।

--- উইডাই , আন্নের দ্যাশের বাড়ি আছিল সিলেট । আমার আছিল নোয়াখালি ।

বলতে বলতে তিনি খ্যাক খ্যাক করে হাসতে হাসতে ছড়িটা দিয়ে ঠোক্কোর লাগালেন টেবিলটার ওপর আবার ।

ঠোক্কোর শুনে চা নিয়ে ভেতরে ঢোকে খেলা । দরজার বাইরে বোধ হয় অপেক্ষাই করছিল সে ।

#

চায়ের পর্ব শেষ হলে সহদেব বেতের ছড়িটা একটু অন্যভাবে ঠোক্কোর দিয়ে বলে ওঠেন ,

--- অখন চলেন আন্নেরে ঘরটা দ্যাখাইয়াদেই । আন্নের খুব চিন্তা হইতেছে বুধয়...

তনু অপেক্ষা করে । ঠোক্কোরের শব্দ শুনে কে এবার ঘরে ঢোকে ? কিন্তু কেউ ঢোকে না । মনে মনে হেসে ওঠে তনু। এই ঠোক্কোরটি বোধ হয় তাকে উদ্দেশ্য করেই ।

সহদেব উঠে দাঁড়ালেন । সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল তনু ।

তনু পেছন নেয় সহদেবের। ওই উঠোন পেরিয়ে সহদেব ওকে নিয়ে দাঁড় করান সিঁড়ি বারান্দার পাশে একটা বন্ধ ঘরের কাছে । দরজায় তালা মারা । সহদেব তালা খুলে ভেতরে ঢোকেন । পেছনে ঢোকে তনু। সহদেব বলেন , এইডা আমার ছুডো ভাই দীপক্যার ঘর , হে অর পরিবার লইয়া ইখানে থাকে । হে গেছে দুধনৈ , আসাম , চাষের ফলন দ্যাখতে , দুধনৈতে আমাগো জমি-বাড়ি আছে ত । অখন ধান কাটনের সুময় । উইখানেও আমাগো চিড়া-মুড়ির ব্যবসা আছে । হে উইখানে তিন-চাইর মাস থাইকব । আন্নে ইখানে তিন-চাইর মাস থাইকতে পাইরবেন ।

তনু দেখল ঘরটা মোটামুটি পরিচ্ছন্নইআছে । চেয়ার-টেবিল খাট সবই আছে । লাইট-ফ্যানও আছে । শুধু বিছানাটা এনে বিছিয়ে দিলেই হয়।

তনু প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে খুশি মনে ,

--- ফার্স্টক্লাশ , ফার্স্টক্লাস , সবই তো রেডিমেড পেয়ে যাচ্ছি , কোন ঝামেলা নেই ,ধন্যবাদ স্যার ।

--- হ , কইলামই ত আন্নের তিন - চাইর মাস কুন চিন্তা করণ লাইগবো না , এর মইধ্যে এট্টা ভাড়াঘর খুজ্যা লইবেন আন্নের পছন্দ মতন ।

--- হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক বলেছেন , ভাড়াঘর খোঁজার একটা টাইম পাওয়া গেল , আপাতত এখানে মাথা গোঁজা যাবে ।

--- হ , ঠিক কইছেন , এই লন চাবিডা , অখন যান আন্নের বিছানা-পত্তর লটর-পটর যা আছে সব গিয়া লইয়া আহেন ...

এ-কথাটা বলার পর কী একটা চিন্তা করলেন সহদেব , তারপর বললেন , না , চলেন , আমার ঘরে আইস্যা বহেন কিছুক্ষণ , আমার এট্টা অট-ভ্যান আছে , আমিই চালাই , ওইটা কইরাই আন্নের মাল-পত্তর গুলান আনন যাইব । তনু শশব্যস্ত হয়ে বলে ওঠে ,

--- না না আপনার আর করার দরকার নেই , যথেষ্ট করেছেন । আমিই একটা গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে আসব জিনিসপত্রগুলো ।

--- ধেৎ , বেশি কতা কইয়েন না ত , চলেন ...

বলতে বলতে সহদেব তনুর হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যান নিজের বসার ঘরে । বসার ঘরে গিয়ে ওই বেতের ছড়িটা দিয়ে এবার একটা ঠোক্কোর লাগালেন টেবিলটার ওপর ।

ওই ঠোক্কোর শুনে প্রথম বউ চলে আসে ।

সহদেব খেলাকে বলেন , শুন , আইজ থিক্যা ইনি তিন মাসের লাইগ্যা আমাগো অতিথি । আমাগো ইখানে খাইবও । সরকারি আপিসের চাকুইরা । দেখবি যাতে দেখভাল ভাল হয় , নয় ত এই সহদেব গুণের বদনাম হইয়া যাইব ....

তনু ভেবেছিল সহদেব এবার দুটো ঠোক্কোর দিয়ে ডাকবে খুকুমণিকে । কিন্তু তিনি সেটা করলেন না । তবে দরজার বাইরে তাকিয়ে দেখে খুকুমণি আড়ালে দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়ে দেখছে ওকে । চোখাচোখি হতেই লজ্জা পেয়ে সরে যায় সেখান থেকে । ওই মুহূর্তে একটা ধোঁয়াশার গহনে ডুবে যেতে থাকে তনু । খুকুমণির কেন এই লুকোচুরি খেলা ? এটা কি ওর কোন সরল চপলতা , নাকি কোন গভীর অনুভূতির আততি , নাকি কোন ছলনার খেলা ...

সহদেবের বদান্যতায় অবশেষে কয়েক দিনের জন্য ঠাই পেয়ে যায় ওঁর বাড়িতে । থাকা-খাওয়ার ভাড়াটাও নিতে চান না তিনি । সম্পর্ক ক্রমশ ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে সবার সঙ্গে । খেলা ওকে নিজের দেওরের মতই দেখে। কোন কিছুই করতে দেয় না ওকে । খুকুমণি একবারের জায়গায় দুবার চা বানিয়ে খাওয়ায়। অফিসের টিফিনের জন্য মুড়ির মোয়া-চিড়ের মোয়া ঠোঙায় মুড়ে তুলে দেয় হাতে । সহদেবের সঙ্গে যখন ভাত খেতে বসে ওর পাতে ভাতের আড়ালে আগে থেকে দিয়ে রাখে আলাদা একটা মাছের টুকরো । তনু ভেতরে ভেতরে আরাম পায় । আবার কখনো কখনো খুকুমণিকে মনে হয় কোন এক অপ্রাকৃত জগতের মায়াবী রমণী বলে । তবে এই আদর-ভালবাসা-আপ্যায়নের মধ্যে থেকেও পাকাপাকি ভাবে থাকা যায় এমন একটি ভাড়াঘরের সন্ধান চালাতে ভোলে না তনু ।

এরই মধ্যে একদিন শেষ দুপুরে খুব হন্তদন্ত হয়ে সহদেব গিয়ে হাজির হন তনুর অফিসে । তিনি জানালেন , তাঁর দুধনৈয়ের বাড়ি থেকে এইমাত্র খবর এসেছে সেখানকার ভোটার তালিকায় তাঁদের পরিবারের সবার নাম নাকি ' ডি ' ভোটার অর্থাৎ সন্দেহের তালিকায় ঢুকে গেছে ।

--- হালা , দেইকচেন , আমাগো দুধনৈয়ের মাটিবাড়ি হইল তিন পুরুষের মাটিবাড়ি , হালা হেরা কয় কিনা আমরা বিদেশি , ' ডি ' ভুটার , সব পেমানপত্তর আমার লগে আছে , দরকার হয় ত কোট্টে যামু , হালাছাড়ুম না , হেরা যা খুশি তাই কইরব , ভাবছেটা কী হালা কুত্তার বাইচ্চা ...

সহদেব ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন সেদিন , তাঁর এমন রাগী মুখ আগে কখনও দেখেনি তনু ।

এরপর সহদেব তনুর হাত দুটো ধরে অনুনয় বিনয় করে বলেন , তনুবাবু আমি অখনই বাস ধরুম দুধনৈর । লাস্ট বাস । ঘরে যাওনের সুময় নাই । আন্নে ঘরে এট্টু কইয়া দিয়েন । আন্নে দেইখেনও হেগ , দুই-তিন দিনের মধ্যেই ফিরা আমু ...

তনু মনে মনে একটা খিস্তি দেয় সহদেবকে , তুমি দাদা হাড় কিপটে , একটা কমদামি মোবাইলও পর্যন্ত রাখতে চাও না ঘরে ...।

পরমুহূর্তে আবার একটা মিষ্টি লোভও ঝিলিক মেরে ওঠে অজান্তে ওর মনে ...। সঙ্গে সঙ্গে আবার দমিয়েও নেয় নিজেকে । নিজেকেই বকুনি দেয় সে । সহদেব চলে গেলেন মনে নানা আশঙ্কা নিয়ে ।

কাজে ডুবে আছে তনু । সেদিনের কাজের চাপটা একটু কম । মানসিক চাপও নেই অত । বেশ হালকা ভাবেই কাজগুলো সেরে ফেলছে সে । এমন সময় পিওন দিল বাহাদুর ঝড়ের মত এসে দশ-বারোটার মত ফাইল ফেলে গেল টেবিলে , আর্জেন্ট। সেদিনই ফাইলগুলো রিলিজ করতে হবে । হেড অফিস শিলং থেকে এসেছে ফাইলগুলো । মাথায় বজ্রপাত হল যেন তনুর । দিল বাহাদুরকে মনে হল একটা রাবণ । মাঝে মাঝে এ রকম হুটহাট ফাইল চলে আসে বাইরে থেকে । কাজের চাপ বেড়ে যায় তখন । সেদিনও তাই হল । ইচ্ছে ছিল তাড়াতাড়ি ছুটি নিয়ে স্থানীয় বাঙালি ক্লাবটিতে গিয়ে ভাড়াঘরের খোঁজ নিয়ে বাড়ি ফিরবে , সেটা আর হল না । অনন্যোপায় হয়ে দিল বাহাদুরের পিঠ বুলিয়ে , কুড়িটা টাকা হাতে ধরিয়ে পাঠায় সহদেবের বাড়ি খবরটা দেওয়ার জন্য , তারও যে যেতে দেরি হবে সে খবরটাও দিয়ে দিতে বলল বাহাদুরকে।

কাজ সারতে সারতে প্রায় রাত নটা । অফিসে তনু ছাড়া আছে কেবল হোসি সাংমা আর দিল বাহাদুর । হোসি সাংমার বাইক আছে , সে বাইকে করে পৌঁছে দিল তনুকে । এ পাহাড়ি শহরে রাত আটটা বাজতেই ঘুমের আয়োজন শুরু হয়ে যায় । এ-বাড়িতে কেউ জেগে আছে কিনা বোঝা গেল না । সাংমা চলে গেলে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে অন্ধকার বাড়িটার কাছে তনু । হঠাৎ চোখ চলে যায় ছাদের দিকে ওর ।একটা ছায়ামুখ সেখানে দাঁড়িয়ে । একটু বাদেই সরে যায় মুখটা । তনু ধীরপায়ে ঢোকে বাড়ির অঙ্গনে । তারপর ঢোকে নিজের ঘরে । লাইট জ্বালিয়ে দেখে ছিমছাম গোছানো তার ঘরটা । বিছানাটা সুন্দর করে পাতা । ধূপদানিতে জ্বলছে ধূপকাঠি । টেবিলে ফুলের ভাস । এর আগে কোনদিন হয়নি এ রকম । হাতমুখ ধুয়ে রান্নাঘরের কাছে গিয়ে দেখে রান্নাঘরের দরজা খোলা । ভেতরে বাতি জ্বালানো । টেবিলে তার খাবারগুলোথালা দিয়ে ঢাকা । চারদিকে তাকায় একবার তনু । খেলা-খুকুমণি কেউ ধারেকাছে নেই । ওদের ঘরও অন্ধকার । নিশ্চয়ই ওর জন্য অপেক্ষা করে করে ঘুমিয়ে পড়েছে ওরা । কিন্তু ছাদের ওপর যে-ছায়ামূর্তিটিকে দেখা গেল সে কে ? ভেবে কূল পায় না তনু ।

তনু খেয়ে নেয় একা একা । অন্যদিন সহদেব আর সে দুজনে মিলে খায় গল্প করে করে । আজ সহদেব নেই , কেমন খালি খালি লাগছে বাড়িটা । ওর ছড়ির শব্দ , হইচই , জোরে-জোরে কথা বলা । লোকটা যতক্ষণ জেগে থাকে ততক্ষণ যেন বাড়িটা কাঁপতে থাকে ।

খেয়েদেয়ে মুখ ধুয়ে , লাইট নিভিয়ে , দরজাটা ভেজিয়ে বেরিয়ে এল তনু । রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে তার ঘরের দিকে যেতে পেরোতে হয় চিলতে সিঁড়িবারান্দার আড়াল । সিঁড়িবারান্দায় টিমটিমে আলোটা জ্বলছে । এই আড়াল পেরোতে যেতেই কার সঙ্গে যেন ধাক্কা লাগল । আঁতকে উঠে তার গলা দিয়ে বেরিয়ে এল ভীরুশব্দ--- কে ?

যার সঙ্গে ধাক্কা লাগল সেখান থেকে অস্ফুট আওয়াজ এল--- চুপ ।

একটু সতর্ক হয়ে তনু দেখে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে খুকুমণি । তনু অনেকটা বিহ্বল , অনেকটা প্রশ্নকাতর হয়ে ওঠে খুকুমণিকে দেখে । খুকুমণি আজ পরেছে লাল রেশমি শাড়ি , হাতে কাঁকন , গলায় হার , চুলের খোপাটি বেঁধেছে পরিপাটি করে। কপালে লাল টিপ । সিঁথিতে জ্বলজ্বল করছে সিঁদুর । সেজেছে মনের মত করে ।

তনু তাকিয়ে থাকে খুকুমণির দিকে । খুকুমণির দুচোখে কী এক অশান্ত , গভীর আহ্বান , নীল উপকথা । তনুর অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে । তনু দেখে খুকুমণির হাতে রয়েছে একটা সাদা গোলাপ ফুল ।

খুকুমণি ওই গোলাপটি তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে , লও এই ফুলডা আমার খোঁপায় গুইজ্যা দাও ।

তনু এই পাহাড়ি ঠান্ডার ভেতর ঘামতে শুরু করে। হাত-পা কাঁপছে । এ যেন এক অপার্থিব আহ্বান । সে যেন তার নিজের অধীন থেকে ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে । ক্রমশ বশে চলে যাচ্ছে খুকুমণির । কী এক আশ্চর্য অলৌকিক ক্ষমতা ভর করেছে যেন খুকুমণির ভেতর । তনু কাঁপা কাঁপা হাতে ফুলটি খুকুমণির হাত থেকে নিয়ে গুঁজে দেয় ওর খোঁপায় ।

খুকুমণি মিষ্টি হাসে এবার । তনু এ হাসি যেন প্রথম দেখল আজ । দুনিয়ায়এ হাসি যেন আগে কখনও দেখেনি সে । মুগ্ধ হয়ে যায়। খুকুমণি এবার ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে , এইবার আমারে কী করবা কর ।

তনু যেন এই জগৎ-সংসার থেকে ছিটকে চলে যাচ্ছে অন্য কোন অজানা জগতে । বাস্তব-অবাস্তব , সত্য-অসত্যের সংঘাতে বিস্ফোরণ উঠল তার মনের ভেতর । আবিষ্কার করল নিজেকে , সেও তো , দেহে-মনে খুকুমণিকে সত্যি সত্যি চেয়েছিল কোন এক অসতর্ক মুহূর্তে । কিন্তু সেটা ছিল ন্যায়-অন্যায়ের আবরণে ঢাকা । তার ওই চাওয়া ছিল একটা রঙিন ফানুস । যদিও খুকুমণিও সাড়া দিয়েছিল তার ওই চাওয়ায় । সবই ওই চোখের ভাষায় । সেখানেও দোলা ছিল দ্বন্দ্ব-অন্তর্দ্বন্দ্বের ঢেউয়ের , সামাজিক রীতিনীতির বাধানিষেধের।

কিন্তু সবকিছু চূর্ণ-বিচূর্ণ করে খুকুমণি আজ চাইছে তার শরীরটা । তনুর ওই অবাস্তব চাওয়াটাও এত দ্রুত , এত সহজে এসে পৌঁছে যাবে তার কাছে বাস্তব রূপ নিয়ে , যেন সব কিছুই ভাবনার ওপারে । আর কিছুই ভাবতে পারে না তনু । নিজেকে আর বেঁধে রাখতে পারে না । এই পরিবেশ , এই সময় , এই আড়াল , খুকুমণির আর্ত আহ্বান ... ন্যায়-অন্যায় , বিশ্বাস-অবিশ্বাস সব কিছু ভুলে গিয়ে মন-প্রাণ- শরীর দিয়ে জড়িয়ে ধরে খুকুমণিকে। চুম্বনে-চুম্বনে ভরিয়ে দিতে থাকে খুকুমণির অধর , কপোল ...

একসময় পাঁজাকোলা করে খুকুমণিকেনিয়ে যায় তনু তার নিজের ঘরে । তনুর ঘরের ধূপকাঠিগুলো তখনও জ্বলছে । ধূপকাঠিগুলো জ্বালিয়ে দিয়েছিল খুকুমণিই ।

টেবিলের ওপর ফুলদানিতে টাটকা টাটকা পাহাড়ি ফুল । ওগুলোও সাজিয়েছে খুকুমণিই । ...

পরদিন অনেক বেলাতেই ঘুম ভাঙল তনুর । চোখ ফিরিয়ে দেখে পাশে খুকুমণি নেই । কখন সে চলে গেছে বিছানা ছেড়ে টের পায়নি তনু । দরজাটা ভেজানো । গত রাতের কথা মনে পড়তেই আত্মগ্লানিতে ভেঙে পড়ে সে । কাজটা বিশ্বাসঘাতকতাই হয়ে গেল । সহদেবের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা । কীভাবে মুখ দেখাবে সহদেবের কাছে । খুকুমণির কাছেও বা কীভাবে দেখাবে মুখ । খুকুমণির কাছে হেরে গেছে সে ।

আশ্চর্য , এরপর থেকে একটিবারের জন্যও খুকুমণির মুখটি দেখতে পায়নি তনু । সব সময় আড়ালে আড়ালে থেকেছে সে । এ-কেমন ছলনা খুকুমণির বুঝে উঠতে পারে না তনু । দুদিন বাদেই ফিরে আসেন সহদেব । আসা মাত্রই জেগে ওঠে বাড়িটা । তাঁর ছড়ির শব্দ , নির্দেশ , আদেশ , হুঙ্কার , হইচই , জোরে-জোরে কথা বলা । খেলা-খুকুমণি বাঁধা পড়ে যায় আবার দৈনন্দিন গৎ বাঁধা জীবনে ।

এরই মধ্যে হঠাৎ একদিন অফিসে গুয়াহাটির এক পুরোনো বন্ধু শৈলেশের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় তনুর । শৈলেশ এই তুরা শৈল-শহরেই কাজ করে , এলআইসি-তে । এসেছিল ছেলের বার্থ-সার্টিফিকেটের জন্য । ওর কাছ থেকেই পেয়ে যায় একটি ভাড়াঘরের খোঁজ ।

শৈলেশকে পেয়ে নিজের টেবিলে এনে বসায় তনু । প্রথমেই জিজ্ঞেস করে শৈলেশকে --- তুই কোথায় থাকিস রে শৈলেশ ?

শৈলেশ জবাব দেয়, এই কাছেই , ফ্যান্সি ভ্যালিতে ---

--- ভাড়াবাড়ি ?

--- হ্যাঁ । ভাড়াবাড়ি তো বটেই । এখানে নিজের বাড়ি কোথায় থাকবে ।

--- আমার একটা ভাড়াবাড়ির দরকার রে শৈলেশ ।

--- চাই তোর ভাড়াবাড়ি ? আমার পাশের ব্লকটা খালি আছে এখনও ।

--- তাই নাকি ?

লাফিয়ে ওঠে তনু ।

--- হ্যাঁ , কথা বলতে পারি ।

--- হ্যাঁ , প্লিজ প্লিজ কথা বল ।

তনুর গলায় ব্যগ্রতা ।

--- হবে হবে , দাঁড়া এখনই কথা বলছি ।

শৈলেশ মোবাইলে কথা বলে মালিকের সঙ্গে । ঘরটা পেয়ে যায় তনু ।

শৈলেশ হাসতে হাসতে বলে ,

--- নিশ্চিন্ত হলি তো , এবার বল তোর খবর । এখন কোথায় আছিস ?

তনু জবাব দেয় , ওই দুর্গাবাড়ির কাছে সহদেব গুণের বাড়িতে ।

--- ও সহদেব , ওই বুড়ো ।

শৈলেশ অনেকটা উত্তেজিত হয়ে ওঠে ।

--- হ্যাঁ , তুই চিনিস নাকি ?

--- সহদেব গুণকে এখানকার সব বাঙালিই চেনে ।

কথাটা বলে তনুর কানের কাছে মুখটি নিয়ে ফিসফিসিয়ে আবার বলে , বুড়ো দুটো বিয়ে করেছে । প্রথম বউয়ের বাচ্চাকাচ্চা হল না বলে আরেকটা বিয়ে করেছে । সেটারও হচ্ছে না বলে আবার আরেকটা বিয়ে করবে বলে ভাবছে ....

বলতে বলতে হো হো করে হেসে ওঠে শৈলেশ । তারপর আবার বলে , চারদিকে বলে বেড়াচ্ছে ওর দুই বউই নাকি বাঁজা । আমার তো মনে হয় বুড়োই বাঁজা ...

বলতে বলতে ওই হাসি দীর্ঘায়িত করে সে ।

হাসিটা থামিযে এবার একটু ধীর হয়ে বলে , তবে বাচ্চাকাচ্চা নেই বলে বুড়োর মনে বড় দুঃখ রে । ও চায় ছেলেমেয়ে হয়ে ওঁর পুরো বাড়ি ভরে উঠুক । এমন খাই ওঁর ...

তনু কোন প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে না । কেমন আনমনা হয়ে যায়। শৈলেশ একটু দমে গেল ওর এই নিরুৎসাহিতা দেখে ।

কয়েকদিনের মধ্যে সহদেব গুণের ঘরের পাট চুকিয়ে তনু চলে আসে শৈলেশের খুঁজে দেওয়া নতুন ভাড়াঘরে । ওই ঘটনার পর খুকুমণিকে একটু ক্ষণের জন্যও কাছে দেখতে পায়নি তনু । খুকুমণিও ওর দিকে চোখ তুলে তাকায়নি । বিদায় নেবার দিনও আড়ালে থেকেছে । কাছে আসেনি ।


#

এরপর কেটে গেছে প্রায় দেড় বছর । এই দেড় বছরে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে তনুর জীবনে । ছ-মাস হল বিয়ে করেছে । শিলচরের মেয়ে । বউ এনে তুলেছে এখানে । নতুন ভাড়াবাড়িতে। এখন বউয়ের রান্না খাবার খেয়ে অফিস যায়। একটা বাইক কিনেছে । ওই বাইকে চড়ে অফিস যাওয়া আসা করে । টিফিন খেতে বাড়ি আসে । প্রমোশনও হয়েছে একটা । নতুন সংসার , প্রমোশন , নতুন উদ্যম । সব নিয়ে সুন্দর গতিময় জীবন তনুর ।

একদিন অফিসে ঘাড় গুঁজে কাজ করছে একমনে । হঠাৎ টেবিলের ওপার থেকে কে যেন ডাকল, তনুবাবু । মুখ তুলে দেখে , সহদেব গুণ । কোলে তাঁর একটি শিশুসন্তান ।

সহদেবের মুখে খুশির হাসি । ওই হাসি মুখে রেখেই বলে ওঠেন তিনি , আমার পোলার এট্টা বাথ সাট্টিফিকেট লাইগব, এই যে আমার পোলা , আমার খুকুমণির মানে আন্নের ছুটো বউদির উপহার --- বলতে বলতে হাসিটা আরও ছড়িয়ে দেন তিনি তাঁর মুখে ।


তনু মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শিশুটির দিকে ।